কলকাতা: বিশাল ড্রিমলাইনারটা হঠাৎ ব্যাপক ঝাঁকুনি দিতে শুরু করল। সকলের মুখেই তখন উদ্বেগের ছোঁয়া। যাঁরা নিত্যদিন যাতায়াত করেন, তাঁরা এই নিত্য ঝাঁকুনির সঙ্গে পরিচিত হলেও, নিত্যই তারা উদ্বিগ্ন হন। কেউ একটা পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, ল্যান্ড করছে। তৎক্ষণাৎ স্বগোক্তি ভেসে এল, বাবা ল্যান্ডিং না মহা পতন! সামনে বসা বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজলেন, তারপর স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলেন জানালার দিকে। বিমানটা নামছে। কলকাতা থেকে উড়ান দিয়ে দিল্লি হয়ে পৌঁছবে লন্ডন। দিল্লিতে নেমে যাবেন দিলীপ ঘোষ সহ বঙ্গ বিজেপির একগুচ্ছ নবনির্বাচিত সাংসদ।
উদ্বেগের দফতরে তালা দেওয়ার জন্য এখন মানসিক ব্যস্ততা দরকার। মনে হল, দিলীপ ঘোষকে রসিকতায় টেনে নিতে পারলেই চাপটা হাল্কা হয়ে যাবে। মজা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, কি দাদা আপনি হলেন রাজ্য সভাপতি অথচ আপনি বসে আছেন ইকনমি ক্লাসে? আর আপনার দলের দুই সাংসদকে দেখলাম, গা এলিয়ে বসে আছেন বিজনেস ক্লাসে। দিলীপ ঘোষ মানেই হই হই আড্ডা আর ভরপুর রসিকতা। রাজনীতির কথা উচ্চারণ না করেই ঘন্টার পর ঘন্টা সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারেন সঙ্ঘের এই প্রচারক। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বললেন, "ওরে বাবা! আমার অত টাকা কোথায়? দল যা দেয়, ওতেই চলতে হয়। ওরা নিজেদের টাকায় টিকিট কেটেছে। ওদের আছে, তাই আরামে যাচ্ছে। দিলীপ ঘোষ বললেন বটে, কিন্তু বঙ্গ রাজনীতিতে এটা একটু বেমানানই ঠেকল। এরাজ্যের কোনও নেতা কখনই তাঁর দলের শীর্ষ নেতাকে এই বার্তা দেন না যে দেখ, আমি অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে তোমার থেকে আলাদা বা তোমার চেয়ে এগিয়ে।
বিমানটা রানওয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে স্থির হল এক সময়। তারপর যে যার মতো হুদ্দুর করে নেমে যাওয়া। হাতে মাত্র দুটো দিন, দ্বিতীয়বারের জন্য শপথ নেবে মোদি সরকার। তার ওপর বিজেপির ঝুলিতে তিনশর বেশি আসন। অন্য দলের ওপর নির্ভরতা শূন্য। কার্যত সাফল্যের শিখরে গেরুয়া শিবির। সেই সাফল্য উদযাপনে শামিল বাংলার ১৮ জন বিজেপি সাংসদ। এসবই নজিরবিহীন। আক্ষরিক অর্থেও বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বের চোখে তখন শুধু স্বপ্নের ঘনঘটা। একদিকে মন্ত্রী হওয়ার হাতছানি, অন্যদিকে ২০২১-এর উজ্জ্বল সম্ভাবনার চূড়ান্ত আশাবাদ। রাজ্য বিজেপি নেতারা ধরেই নিয়েছিলেন, ভোটের আগে দিল্লি যেভাবে বাংলা বাংলা করেছে, এবার মন্ত্রিসভা গঠনের সময় নিশ্চয়ই তাদের আলাদাভাবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। বাবুল সুপ্রিয় ছিলেন প্রতিমন্ত্রী, এবারও তিনি প্রতিমন্ত্রীই হলেন। সঙ্গে যোগ হল নতুন নাম দেবশ্রী চৌধুরী, তিনিও প্রতিমন্ত্রী।
২০১৯- এর ২৬ মে'র ড্রিমলাইনারের সেই যাত্রা আজও একই পথে এগচ্ছে বাংলার রাজনীতির আকাশে। আচমকা ঝাঁকুনি দিচ্ছে, উদ্বেগের তীব্রতায় ওঠানামা হচ্ছে, আবার স্থির হয়ে আশ্বস্ত করছে। দিল্লি খালি হাতে ফিরিয়েছে, এবার পাওনা-গন্ডা বুঝে নিতে হবে বাংলার মাটিতেই, ঠিক এই শরীরী ভাষা নিয়ে বাংলায় ফিরে নতুন ইনিংস শুরু করতে গিয়েই ব্যাপক ঝাঁকুনি খেয়ে হতভম্ব দল। ঝোড়ো হওয়ায় দল যেন টালমাটাল। ঝড়ের নাম মনিরুল ইসলাম। সবাই যখন নতুন অক্সিজেন নিয়ে বাংলার মাটিতে ঝাঁপাতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিল। মুকুল রায়ের হাত ধরে বিজেপির সদর দফতর দিল্লি গিয়ে যোগ দিলেন মনিরুল। পত্রপাঠ প্রতিবাদের ঝড় উঠল। দিকে দিকে গণ ইস্তফার হুমকি। পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর। হস্তক্ষেপ করল আরএসএস। সিদ্ধান্ত হল পরিস্থিতি সামাল দিতে মনিরুলকে গ্যারেজ করে দাও। দল প্রকাশ্যে কোনও সম্পর্ক রাখবে না তার সঙ্গে। শুধু মনিরুল নয়, এক্কেবারে তৃণমূলের কায়দায় মুকুল রায় শুরু করলেন বিপক্ষ শিবির ধ্বংসের কাজ। উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক পুরসভায় ফাটল ধরালেন মুকুল। কিন্তু শেষ হাসি আর বাস্তবের মুখ দেখল না। পাল্টা খেলায় গেরুয়া শিবিরকে একেবারে দাঁড় করিয়ে গোল করে দিল শাসক দল। সব পুরসভাই ফের দখলে নিল তৃণমূল। বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব কাটাছেঁড়া বৈঠকে স্বীকার করে নেন,এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেছে দল। কারণ, সরকারি শক্তির সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে ওঠা যাবে না, সেটা বোঝা উচিত ছিল। এর ফলে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আসার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটা থমকে গেল পুরোপুরি। বিজেপি নেতৃত্ব মনে করে, পুরসভাগুলো পুনর্দখল করে তৃণমূল নিজেদের ঘরেও এই বার্তা দিতে পারল যে, সাম-দাম-দন্ড, সবই মজুদ আছে তূণে।
গেরুয়া শিবিরের জন্য আর একটা ঝাঁকুনির নাম প্রশান্ত কিশোর। দল যখন সিন্ডিকেট ইস্যুতে শাসক দলকে অনেকটাই কোণঠাসা করে ফেলেছে, তৃণমূলে ভাঙন ধরাতে মাঠে ব্যাপক সক্রিয় বিজেপি, ঠিক সেইসময় প্রশান্ত কিশোরকে জাদুদণ্ডের মতো বাংলার মাটিতে নিয়ে এলেন তৃণমূল নেত্রী। প্রথম দিকে প্রশান্তের নাম বললে নাক কুচকোতেন বিজেপি নেতারা। দিলীপ ঘোষ তো বুক বাজিয়ে বলতেন, " প্রশান্ত যে স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুলের হেডমাস্টার অমিত শাহ, ওসব নিয়ে আমরা ভাবি না।" কিন্তু ধীরে ধীরে বিজেপি নেতারা চায়ের আড্ডায় চাপা স্বরে স্বীকার করতে আরম্ভ করলেন, প্রশান্ত কিন্তু তৃণমূলের নিচুতলার অস্থিরতা অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছেন। একটা বার্তা দলের সর্বস্তরে পৌঁছে গেছে, তৃণমূল ঘর গুছিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। ফলে বিজেপির কাজটা আর যেমন ভাবা হয়েছিল, তেমন সহজ হল না। সেইসঙ্গে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো প্রকাশ্যে চলে এল অসমের এনআরসি তালিকা। ৬ নম্বর মুরলিধর সেন লেনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল কালবৈশাখী। দলের সাজানো ঘুঁটি সব ওলটপালট। শুরু হল ড্যামেজ কন্ট্রোল। দফায় দফায় বৈঠক। একাধিকবার কলকাতায় এলেন অমিত শাহ, দলের ভাষায় চাণক্য। দল ঘুরে দাঁড়াবার মরিয়া চেষ্টায় সামনে আনল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় ঘর সাজিয়ে তুলতে এটাই হল বিজেপির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার নিয়ে গেরুয়া বাহিনী তৃণমূলের মোকাবিলায় সম্মুখ সমরে যখন ব্যস্ত, তখনই হানা দিল অদৃশ্য ভাইরাস।
গেরুয়া শিবিরের স্বপ্নের গাছে নাকি ফের জল-সার পড়তে শুরু করেছে। তেমনটাই দাবি করছেন বিজেপি নেতারা। করোনার প্রথম ধাপেই চাল দুর্নীতি নাকি তৃণমূলকে শুরুতেই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। যদিও শাসক দল একে দিবাস্বপ্ন বলে উপহাস করে, কিন্তু বিজেপি নেতাদের মুখের হাসি কিন্তু চওড়া হচ্ছে ক্রমশ। তাদের দাবি, শুধু খাবার চাল নয়, করোনা মোকাবিলায় সরকারের কৌশলী চাল মানুষকে রুষ্ট করে তুলেছে। সেইসঙ্গে আমফান পরবর্তী ঘটনাবলীর জেরে এখন নাকি অ্যাডভান্টেজ গেরুয়া শিবির। তারা এখন প্রকাশ্যে চলে আসা তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ লড়াইকে, নিজেদের শ্রীবৃদ্ধির কাজে লাগাতে কৌশলি বিবৃতি দিতে শুরু করেছে। লকডাউনে দলের কোনও প্রকাশ্য কর্মসূচি নেই, ফলে প্রতিদিন চলছে ভিডিও বৈঠক। রাজনৈতিক ঘটনাবলীর চুলচেরা বিশ্লেষণ সঙ্গে রণকৌশল তৈরির কাজ। সূত্রের খবর, নির্দিষ্ট সময়ে ভোট হবে ধরে নিয়েই নিজেদের ঘুঁটি সাজাতে আরম্ভ করেছেন গেরুয়া নেতৃত্ব। বলা হয়েছে, সমস্ত বিধানসভায় সম্ভাব্য প্রার্থী কারা হতে পারেন, কাদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি, দ্রুত তার একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। যার জয়ের সম্ভাবনা বেশি, সে যদি শাসক দলেরও হয়, সেই নামটাও অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। অর্থাৎ সেই প্রতিপক্ষের দুর্গ ভেঙে নিজের প্রাসাদ নির্মাণের পুরনো কৌশলকেই আঁকড়ে ধরার ইঙ্গিত দিয়ে কৌশল রচনায় ব্যস্ত বিজেপি।
Election Results 2024
(Source: ECI/ABP News/ABP Majha)
এগিয়ে আসছে ভোট, দ্বন্দ্ব বাড়ছে ঘাস-পদ্মের, তৃণমূলের ঘর ভেঙে ফ্রন্টফুটে আসতে মরিয়া বিজেপি
ওয়েব ডেস্ক, এবিপি আনন্দ
Updated at:
30 May 2020 03:40 PM (IST)
দ্বিতীয় মোদি সরকারের বর্ষপূর্তিতে বঙ্গ বিজেপি কোথায় দাঁড়িয়ে? পর্যালোচনা করলেন দীপক ঘোষ
NEXT
PREV
আজ ফোকাস-এ (aaj-focus-e) লেটেস্ট খবর এবং আপডেট জানার জন্য দেখুন এবিপি লাইভ। ব্রেকিং নিউজ এবং ডেইলি শিরোনাম দেখতে চোখ রাখুন এবিপি আনন্দ লাইভ টিভিতে ।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -