নয়াদিল্লি: প্রথম নরেন্দ্র মোদি সরকার জোর দিয়েছিল স্বচ্ছ ভারত, জন ধন যোজনা, উজ্জ্বলা যোজনার মত জনমুখী প্রকল্পের ওপর। তিন তালাক বিল আনা হলেও লোকসভা ভোট ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় বিলটি তামাদি হয়ে যায়। কিন্তু মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই আগে পাশ করায় তিন তালাক বিল। একইভাবে পরপর চলে আসে দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির ম্যানিফেস্টোয় স্থান পাওয়া রাম মন্দির, ৩৭০ ধারা লোপাট ও নাগরিকত্ব সংশোধী আইন।

দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য লড়ার সময় নরেন্দ্র মোদি বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাঁর বেশিরভাগ একনিষ্ঠ অনুরাগীও বিশ্বাস করেননি, সেগুলো সত্যিই পূরণ করা হবে। কিন্তু প্রথম বছরেই সমর্থক-বিরোধী সব পক্ষকে অবাক করে দিয়ে মোদি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলুন, দেখা যাক।

তিন তালাক

তিন তালাকের অন্য নাম তালাক এ বিদ্দাত অর্থাৎ তাৎক্ষণিক বিবাহ বিচ্ছেদ এবং তালাক এ মুঘালাজাহ বা অপরিবর্তনীয় বিবাহ বিচ্ছেদ। এর ফলে মুসলিম পুরুষরা তিনবার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে স্ত্রীকে ইসলামীয় আইনমতে ডিভোর্স দিতে পারতেন। এমনকী হোয়াটসঅ্যাপ, এসএমএসে তিনবার তালাক লিখে দিলেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত। ২৩টি দেশে এই প্রথা নিষিদ্ধ, এগুলির মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশী ইসলামীয় দেশগুলিতেও। কিন্তু ভারতে তিন তালাকের ফলে মুহূর্তে ঘর হারিয়েছেন অসংখ্য মুসলিম মহিলা। ভারতে এ নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক চলছে, বিভিন্ন স্তরের মানুষ বারবার অভিযোগ করেছেন, এই প্রথা ন্যায়, লিঙ্গ সাম্য, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে আঘাত করছে। এ নিয়ে বিতর্ক চরমে ওঠে ১৯৮৫-র শাহ বানু মামলার পর। জড়িয়ে পড়ে ভারত সরকার এবং সুপ্রিম কোর্ট, প্রশ্ন ওঠে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।

২০১৬-র ৮ ডিসেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয়, তিন তালাক অসাংবিধানিক, তা মুসলিম মহিলাদের মানবাধিকার খর্ব করছে। ২০১৭-র মার্চে ১০ লাখের ওপর ভারতীয় মুসলমান, যাঁদের বেশিরভাগ ছিলেন মহিলা, তিন তালাক প্রথা শেষ করার দাবিতে পিটিশন স্বাক্ষর করেন। সে বছরই ২২ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে, জানিয়ে দেয়, মুখে পরপর তিনবার তালাক উচ্চারণ করলেই বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয় না। । ৫ বিচারপতির বেঞ্চের ৩ জনই এই প্রথা বেআইনি বলেন, যদিও বাকি ২ জন বলেন, প্রথা আইনসম্মত তবে তা নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের আইন আনা উচিত।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও একশর মত তিন তালাক মামলা সামনে আসার পর প্রথম মোদি সরকার এ ব্যাপারে একটি বিল সংসদে নিয়ে আসে। সে বছরই ২৮ ডিসেম্বর লোকসভায় পাশ হয়ে যায় দ্য মুসলিম উওমেন (প্রটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ) বিল, ২০১৭। বিলে প্রস্তাব দেওয়া হয়, এর ফলে যে কোনও ধরনের তিন তালাক- তা মৌখিকই হোক বা লিখিত অথবা ইমেল, এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপের মত ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পাঠানো- তা বেআইনি হবে, এভাবে ডিভোর্স দেওয়ার চেষ্টা হলে স্বামীর ৩ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। কিন্তু আরজেডি, এআইএমআইএম, বিজেডি, এডিএমকে ও এআইএমএল সাংসদরা এই বিলের বিরোধিতা করেন। যদিও সমর্থন করে কংগ্রেস।  ১৯টি সংশোধনী আনা হয় বিলটিতে, সবকটিই অগ্রাহ্য হয়।

কিন্তু লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিলটি তামাদি হয়ে যায়। ২০১৯-এর জুলাইতে রাজ্যসভায় তিন তালাক বিল পাশ হওয়া নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিপুল জয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবারের ভোট লড়েছিল বিজেপি, ক্ষমতায় আসার পর জুলাইতেই তারা এই বিলটি রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে নেয়। এ ব্যাপারে  বিলও আনে প্রথম মোদি সরকার ২০১৯-এ লোকসভা ভোট জেতার পর মোদি ২.০ মন্ত্রিসভা সেটি পাশ করিয়ে ফেলে।

৩৭০ ধারা

১৯৫৪ থেকে ২০১৯-এর ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত জম্মু কাশ্মীরে বহাল থেকেছে বহু বিতর্কিত ৩৭০ ধারা। এর ফলে তাদের পৃথক সংবিধান, রাজ্যের নিজস্ব পতাকা ও স্বশাসনের অধিকার ছিল। এই ধারা কার্যকর করতে ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ নির্দেশ কার্যকর হয়।  ৩৫এ ও ৩৭০ ধারার আওতায় জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দারা কিছু বিশেষ আইনের সুবিধে পেতেন, নাগরিকত্ব, সম্পত্তির অধিকার ও দেশের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দাদের তুলনায় তাঁদের কিছু বিশেষ মৌলিক অধিকার ছিল। এর ফলে অন্যান্য রাজ্যের ভারতীয় নাগরিকরা জম্মু কাশ্মীরে জমি বা সম্পত্তি কিনতে পারতেন না।

২০১৯-এর ৫ অগাস্ট দ্বিতীয় মোদি সরকার ১৯৫৪-র নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে একটি সাংবিধানিক নির্দেশ ইস্যু করে, তাতে বলা হয়, ভারতীয় সংবিধানের সমস্ত ধারা জম্মু কাশ্মীরে এবার থেকে প্রযোজ্য হবে। বিলুপ্ত করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা। সংসদে এই যুগান্তকারী ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সংসদের দুই কক্ষেই এই প্রস্তাব দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ করিয়ে নেয়। এরপর ৬ অগাস্ট ইস্যু হয় আরও একটি নির্দেশ, তার ফলে ক্লজ ১ ছাড়া ৩৭০ ধারার যাবতীয় ক্লজ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

৩৭০ ধারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে বিজেপি, প্রতিবার তাদের ভোটের ম্যানিফেস্টোয় উঠে এসেছে এই ধারা বিলোপ করার প্রতিশ্রুতি। ঘোষণার আগে লে ছাড়া গোটা জম্মু কাশ্মীর মুড়ে দেওয়া হয় নিরাপত্তা বাহিনীতে। শ্রীনগর-জম্মু জাতীয় সড়কের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা হয়। ৩৭০ বিলুপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন রুখতে রাজ্যের বিরোধী রাজনীতিকদের গৃহবন্দি করা হয়, বিচ্ছিন্ন করা হয় ইন্টারনেট যোগাযোগ। সাধারণ মানুষের যাতায়াতেও কড়াকড়ি করা হয়। এরপর সংসদে জম্মু কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল আনে কেন্দ্র। রাজ্যটিকে দুভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়, একটি জম্মু কাশ্মীর, অন্যটি লাদাখ। লাদাখ থাকবে সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে, তবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় জম্মু কাশ্মীরে ভোট হবে।

রাম জন্মভূমি

সরযূ নদীর তীরে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা শহরে শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল। এই ইস্যুতে বছরের পর বছর আন্দোলিত হয়েছে ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতি। এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাস ছিল, ঠিক যেখানে শতাব্দীপ্রাচীন বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন রামচন্দ্র। এই থিওরি অনুযায়ী, মুঘলরা ওই স্থান চিহ্নিত করে নির্মিত হওয়া একটি মন্দির ধ্বংস করে গড়ে তোলে বাবরি মসজিদ। যাঁরা এই মতের বিরোধী ছিলেন, তাঁরা বলেন, রাম জন্মভূমির দাবি ওঠে উনবিংশ শতাব্দীতে, ওইখানেই রামের জন্ম হয় তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাবরি মসজিদের অবস্থান ও তার আগে এখানে কোনও মন্দির ছিল কিনা, তা ধ্বংস করে মসজিদ গড়ে উঠেছে কিনা তা নিয়ে এই রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক-ধর্মীয় বিতর্ক গোটা বিশ্বে পরিচিত হয় অযোধ্যা বিতর্ক নামে।  ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর ধ্বংস করা হয় বাবরি মসজিদ, দেশ জুড়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারত, আফগানিস্তান ও নেপালের বেশ কিছু স্থান রামচন্দ্রের জন্মভূমি হিসেবে দাবি করা হয়।

কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলে বিতর্ক গড়ায় আদালতে। ২০১০-এর ৩০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাই কোর্টের ৩ বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয়, অযোধ্যার ২.৭৭ একর বিতর্কিত জমি তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। এক ভাগ পাবে হিন্দু মহাসভা যাঁর প্রতিনিধিত্ব করেছিল সেই রামলালা অর্থাৎ শিশু রামচন্দ্র, এক ভাগ নির্মোহী আখড়া ও অন্য ভাগ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। তিন বিচারপতির বেঞ্চ মন্দির ধ্বংসের পর বিতর্কিত কাঠামো তৈরি হয় কিনা সে ব্যাপারে এক মত হয়নি তবে তারা সহমত হয়, মসজিদের আগে ওই স্থানে একটি মন্দিরের কাঠামো ছিল।

সব পক্ষই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। মামলা যায় সুপ্রিম কোর্টে।  শেষ শুনানি চলে ৫ বিচারপতির বেঞ্চে, ২০১৯-এর অগাস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। ৯ নভেম্বর শীর্ষ আদালত নির্দেশ দেয়, হিন্দু মন্দির গড়ার জন্য বিতর্কিত জমি একটি ট্রাস্টের হাতে তুলে দিতে হবে। সরকারকে ৫ একর জমি দিতে হবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে, যাতে তারা একটি মসজিদ গড়ে নিতে পারে। এ বছর ৫ ফেব্রুয়ারি শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টটি তৈরি করে ভারত সরকার।

ঐতিহাসিক এই রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন, এই রায় কারও জয় অথবা পরাজয় হিসেবে দেখা উচিত নয়। রামশক্তিই হোক বা রহিমশক্তি, এখন ভারতভক্তি আরও শক্তিশালী করার সময়। প্রত্যেকের এখন শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখা উচিত।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন   

গত বছর ১১ ডিসেম্বর তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অমুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য একটি বিল পাশ করে ভারতীয় সংসদ। ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে এই বিল পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যাঁরা ধর্মের কারণে ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে। এঁদের মধ্যে ছিলেন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান শরণার্থীরা। কিন্তু মুসলিমদের এই অধিকার দেওয়া হয়নি। ভারতীয় আইনের আওতায় এই প্রথমবার ধর্ম নাগরিকত্ব পাওয়ার  মাপকাঠি হিসেবে উঠে এল।

বিজেপির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোয় প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে ধর্মীয় কারণে ভারতে আশ্রয় নেওয়া জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। নতুন সংশোধনীতে নাগরিকত্ব পেতে এ দেশে থাকার সময়সীমাও ১২ থেকে কমিয়ে ৬ বছর করা হয়।  কিন্তু ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর রেকর্ড বলে, এর ফলে মাত্র হাজারতিরিশের বেশি শরণার্থী উপকৃত হবেন।

নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন হয়। পোড়ানো হয় একাধিক ট্রেন, বাস, রেল স্টেশন। সমালোচকরা বলেন, এটা বিজেপির অ্যাজেন্ডা, এর ফলে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে কেন্দ্র। বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই বিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়, স্থানীয় মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সীমান্তের ওপার থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য তাঁরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি বলে, এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে এ দেশে আসা অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ সহজ করবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত অফিস বলে, এই বিল মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্বাগত হলেও এ ব্যাপারে জাতীয় নীতি নেওয়া হোক, তাতে কোনও বৈষম্য থাকা উচিত নয়। সমালোচকরা বলেন, জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি-র সঙ্গে এই বিল যুক্ত করা হবে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে অসংখ্য মুসলিম পরিচয় হারিয়ে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বেন। মায়ানমার, তিব্বত বা শ্রীলঙ্কার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কেন এই বিলের আওতায় আসবেন না সেই প্রশ্নও ওঠে। কিন্তু ভারত সরকার বলে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তাই সেখানে মুসলিমদের ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হওয়ার প্রশ্ন নেই। বিলটি আইনেও পরিণত করে তারা।