নয়াদিল্লি: কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা এখন মকর সংক্রান্তির দিকে তাকিয়ে। তাঁদের আশা, ১৪ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তির দিনই দলে এক নতুন যুগের সূচনা হবে এবং শীর্ষনেতৃত্ব সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হবে।


এআইসিসি ছাড়াও এখন সবার নজর মতিলাল ভোরা ও আহমেদ পটেলের উত্তরসূরীর দিকে। তাঁদের উত্তরসূরী কারা হবেন, সেটা জানার জন্য সবারই আগ্রহ রয়েছে। ভোরা এতদিন এআইসিসি-র প্রশাসনিক দিকটি দেখছিলেন। অন্যদিকে, তহবিল সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল পটেলের। তাঁরা গত ২০ বছর ধরে যাবতীয় আর্থিক বিষয়টি দেখছিলেন। বিশেষ করে পটেলই আর্থিক বিষয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করছিলেন। এবার হয়তো তাঁদের বদলে অন্য কেউ এই দায়িত্ব নেবেন।

কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের বিষয়ে এখন তিনটি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রতিটি তত্ত্বের পিছনেই যুক্তি আছে। এর মধ্যে একটি তত্ত্ব হল, রাহুল গাঁধীকেই দায়িত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে যুক্তি খুব সহজ। ২০০৪ সালে রাহুল রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দল ও নেহরু-গাঁধী পরিবার তাঁকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়েছে। ২০০৬ সালে তাঁকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে বসানো হয়। এরপর ২০১৩ সালে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি করা হয় রাহুলকে। এরপর কংগ্রেসের সব অংশের সমর্থনের ভিত্তিতে তিনি দলের ৮৭-তম প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এবার যদি তাঁকে ফের দলীয় সভাপতি না করা হয়, তাহলে তিনি কোনও দায়িত্বেই থাকবেন না। ফলে দলের রাজনৈতিক ও শ্রেণিবিন্যাস সংক্রান্ত সমীকরণ বদলে যাবে।

আবার কংগ্রেসের একটি শক্তিশালী অংশের দাবি, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দলের দায়িত্বে থাকুন সনিয়া গাঁধী। তারপর কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন হওয়ার কথা। কংগ্রেসের সংবিধানের ১৮-তম (এইচ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি সভাপতি পদত্যাগ করেন, তাহলে ‘পূর্ণ সময়ের সভাপতি’ নির্বাচন হতে পারে। সেক্ষেত্রে এআইসিসি-র ১,৩০০ জনের মতো সদস্য ভোট দিতে পারেন। তবে সাধারণভাবে কোনও সভাপতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন ১৫,০০০ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্যদের ভোটে।

কংগ্রেসের যে অংশ চাইছে সনিয়াই ক্ষমতায় থাকুন, তাদের মতে, সনিয়ার বিভিন্ন রাজ্য সফর শুরু করা উচিত। সব রাজ্যে গিয়ে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে কথা বলে এনডিএ-বিজেপি-নরেন্দ্র মোদি বিরোধী বৃহত্তর মঞ্চ তৈরির চেষ্টা করা উচিত সনিয়ার। তিনি যদি এই প্রস্তাব মেনে নেন, তাহলে তাঁকে সাহায্য করবেন প্রবীণ নেতা কমলনাথ। আহমেদ পটেল যে ভূমিকা এতদিন পালন করে এসেছেন, সেটাই এবার পালন করতে পারেন কমলনাথ। কোনও পদ ছাড়াই এই দায়িত্ব পালন করতে রাজি কমলনাথ।

কংগ্রেসের মধ্যে শীর্ষনেতৃত্বের বিষয়ে তৃতীয় মত হল, গাঁধী পরিবারের বাইরের কাউকে দলের প্রধান করতে হবে। এক্ষেত্রে উঠে আসছে মুকুল ওয়াসনিক, অশোক গহলৌত, কে সি বেনুগোপালদের নাম। তবে কংগ্রেসের অন্দরে শোনা যাচ্ছে, রাহুলের হাত যাঁর মাথার উপরে থাকবে, তিনিই দলের পরবর্তী প্রধান হবেন।

তবে রাহুল এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু জানাননি। তিনি ২০১৯ সালের মে মাসে পদত্যাগ করার পর থেকেই বলে আসছেন, তাঁর, সনিয়া ও প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর বাইরে অন্য কাউকে কংগ্রেস সভাপতি করা হোক। যদিও কেউই এই প্রস্তাবে রাজি হননি। রাহুলের মত হল, যৌথ ও দায়বদ্ধ নেতৃত্বের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকজন দলের বিষয়ে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করবেন না। কিন্তু কংগ্রেসের প্রায় ১৫০ জনের একটি চক্র রাহুলের এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এই চক্রে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, প্রদেশ কংগ্রেসের প্রধান, কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা এবং অন্যান্য প্রভাবশালী নেতারা আছেন। তাঁরা নিজেদের রাহুল-সনিয়া-প্রিয়ঙ্কার আশীর্বাদধন্য বলে মনে করেন। তাঁরা এমন একটি পরিস্থিতির কথা ভাবতেই পারেন না, যেখানে ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন না গাঁধী পরিবারের সদস্যরা। এই কারণেই কংগ্রেসের নতুন নেতা বাছাই করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অনেকে মনে করেন, নতুন এআইসিসি প্রধান নির্বাচন নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই। কারণ, কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গাঁধী পরিবারের হাতে আছে। ভোরা-পটেলের উত্তরসূরী হিসেবে সনিয়া-রাহুলের পছন্দের কাউকে বেছে নেওয়া নিয়েই আলোচনা চলছে। পরবর্তী প্রজন্মের কাউকে বেছে নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়েও কথা হচ্ছে। কনিষ্ক সিংহ, সচিন পাইলট, মিলিন্দ দেওরা বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, না কি রাজীব শুক্ল, কমলনাথ, অশোক গহলৌত বা ডি কে শিবকুমার বর্তমান পরিস্থিতিই বজায় রাখার পক্ষে মতপ্রকাশ করছেন? তাছাড়া কোষাধ্যক্ষের ভূমিকা এমনই গুরুত্বপূর্ণ, আর্থিক বিষয়ে অন্য কিছু ভাবার অবকাশই নেই। বিশেষ করে যখন পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল, তামিলনাড়ু ও পুদুচেরির বিধানসভা ভোট আর কিছুদিন পরেই হবে।

বর্তমানে এআইসিসি-র হয়ে তহবিল সংগ্রহের দায়িত্বে আছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পবন বনসল। তবে তিনি ভবিষ্যতে এআইসিসি-র পূর্ণ সময়ের কোষাধ্যক্ষ হওয়ার মতো ‘ওজনদার’ নন। এর আগের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষের পদই সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন। এর আগে উমাশঙ্কর দীক্ষিত, অতুল্য ঘোষ, প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি সি শেঠি, সীতারাম কেশরী, মতিলাল ভোরা ও আহমেদ পটেল এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের কাজেই দলের হাইকম্যান্ড সন্তুষ্ট ছিল। কারণ, টাকা কোথা থেকে আসছে এবং কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে তাঁরা গোপনীয়তা বজায় রাখতেন। শুধু টাকার জোগান বাড়ানোই কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষের কাজ না। বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে নেতার (পড়ুন রাহুলের) ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলেও, জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং দলের মধ্যে সমর্থন বজায় রাখার কাজটিও কোষাধ্যক্ষকেই করতে হয়।

এই কারণেই যে কাউকে কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ পদে বসানো যাবে না। রাহুল ও সনিয়া দু’জনই বিশেষ কথা বলছেন না। করোনা আবহে তাঁদের সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলা সহজ নয়। ভোরা ও পটেল সবার সঙ্গে ‘ভার্চুয়ালি’ কথা বলছেন এবং ‘হাইকম্যান্ডের’ কাছে সমস্যাগুলির কথা তুলে ধরছেন। কেউ কেউ চাইছেন, প্রিয়ঙ্কা এই দায়িত্ব পালন করুন। কিন্তু তিনি রাহুলের মত ছাড়া এই দায়িত্ব পালন করবেন না।

রাজীব শুক্ল যদি কোনও দায়িত্ব পান, তাহলে তাঁর পিছনে থাকবেন প্রিয়ঙ্কা। তিনি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার অনেক আগে থাকতেই তাঁর শিবিরের লোক হিসেবে পরিচিত শুক্ল। কনিষ্ক সিংহ রাহুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ এস কে সিংহের ছেলে কনিষ্ক নিউ ইয়র্কের একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। কংগ্রেসের অন্দরমহলে ‘কে’ হিসেবে পরিচিত কনিষ্ক। নেহরু-গাঁধী পরিবারের ট্রাস্ট, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা এআইসিসি-র সম্পত্তি এবং ন্যাশনাল হেরাল্ড সংক্রান্ত আইনি লড়াইয়ের বিষয়টি দেখছেন কনিষ্ক, যিনি প্রয়াত মতিলাল ভোরার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছেন।

আহমেদ পটেলের প্রয়াণের পর থেকেই কংগ্রেস সমস্যায়। দলের অন্দরমহল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালে দলের এক প্রবীণ নেতাকে তহবিল গঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সনিয়া। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। তহবিলের একটি অংশের হিসেব দেওয়া হয়নি। ফলে ভোরা-পটেলের মতো ভরসাযোগ্য কাউকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে গাঁধী পরিবারের সদস্যদের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।