কলকাতা: রাজ্যে ক্রমেই বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। মঙ্গলবারের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন আরও ৩৭২ জন, মৃত ১০। রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে এখন মোট ৮ হাজার ৯৮৫, মৃত বেড়ে ৪১৫। শুধু কলকাতায় আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ৩ হাজার।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে বাড়ছে আতঙ্ক। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার হার কেমন? হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কি খাওয়া যায়? বাড়াবাড়ি হলেই বা কী হবে? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে দেওয়ার চেষ্টা করলেন চিকিৎসক দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতার নামী বেসরকারি এক হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় দিনরাত এক করে দিচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। জানালেন, যত তাড়াতাড়ি রোগের উপসর্গ নিয়ে আসবে করোনা আক্রান্ত, চিকিৎসা ততটা সহজ হবে। দেরি হলেই সমস্যা গুরুতর হয়ে যায়। তখনই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ডাক্তাররাও চিন্তায় পড়ে যান।
দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় জানালেন, এখনও অ্যাসিম্পটোমেটিক করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা অ্যাজিথ্রোমাইসিনের প্রয়োগ চলছে। ব্যবহার করা হচ্ছে আইভারমেকটিন নামে একটি ওষুধও, যা কিনা আসলে কৃমির ওষুধ! কিন্তু এই ওষুধ নাকি করোনা রোগীদের উপর কাজ করছে বলে মনে করছেন ডাক্তাররা। করোনা সংক্রমণ এড়াতে আইসিএমআর ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। যদিও এই ওষুধের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক আছে। তবুও আইসিএমআর এখনও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনে ভরসা রাখছে।
চিকিৎসক জানালেন, চিন্তা শুরু হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধে শুরু হলে। এটিই হল করোনা আক্রান্তদের সবথেকে বড় সমস্যা। প্রথমেই সেই কষ্ট কমানোর দিকে নজর দিতে হয়। পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে দেখে নেওয়া হয়, শরীরে অক্সিজেনের সার্কুলেশন কেমন। তারপর প্রয়োজন অনুসারে মাস্ক অক্সিজেন, হাই ফ্লো নেজাল অক্সিজেন, ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়। তার পর একমো।
অক্সিজেনের সমস্যা গুরুতর হলে, অর্থাৎ যদি Acute Respiratory Distress Syndrome স্তরে পৌঁছে যান রোগী, তখন দরকার পড়ে ভেন্টিলেশনের। অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর হলে তখনই একমো-র কথা ভাবা হয়।
রোগীকে ভেন্টিলেশনে রেখেও বিশেষ উন্নতি না হলে তখন একমো (ECMO) সাপোর্ট দেওয়া হয়। এখানে শরীরে অক্সিজেন জোগানো ও কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দেওয়া হয় কৃত্রিম উপায়ে। এই পদ্ধতিতে রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত ফুসফুস স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে শুরু করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সাপোর্ট দিতে হয়। দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় জানালেন, কলকাতায় এখনও পর্যন্ত ৪ জনের একমো হয়েছে, তার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২জন। আরেকজনও সুস্থতার পথে।
কিন্তু এক্ষেত্রেও যত প্রয়োজন, তত ব্যবস্থা নেই। এই সিস্টেম ভালভাবে চালু রাখতে গেলে অনেক বেশি সংখ্যক দক্ষ, প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন।
শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কম হলে প্রোন পোজিশন অর্থাৎ উলটে শুয়ে থাকলে অনেকটা আরাম মেলে।
করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। হেপারিন দিয়ে রক্ত জমাট বাঁধা আটকানো হয়। এছাড়াও শরীরে জ্বালা যন্ত্রণা কমাতে সামান্য মাত্রায় স্টেরয়েডও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে যখন শরীরে জ্বলনভাব অত্যন্ত বেড়ে যায়, তখন মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়, টোকিলিজুম্যাব ওষুধ। এছাড়াও পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবহার করা হয় সাইটোসর্ব নামে একটি ডিভাইস, যা শরীর থেকে জ্বলন সৃষ্টকারী উপাদান বের করে দেয়।
দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রভাবে হৃদযন্ত্রে গুরুতর সমস্যা শুরু হয়। কিডনি ও পাচনতন্ত্রের সমস্যাও খুব হচ্ছে করোনা রোগীদের। ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীদের মাল্টি অরগ্যান ফেলিওরের মতো সমস্যা হচ্ছে প্রায়ই। কেউ কেউ আবার গন্ধ পাচ্ছেন না।
তবে চিকিৎসকরা এখনও বলছেন, আতঙ্কের কিছু নেই। তবে, বয়স ও সহ-অসুস্থতা সমস্যার জটিলতা বাড়ায়। কম বয়সীদের মধ্যে ধূমপায়ী, মদ্যপায়ী করোনা রোগীদের ঝুঁকি বেশি। দেখা যাচ্ছে, মেদবহুল চেহারাও করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে খারাপ।
তবুও হতাশ হতে বারবার বারণ করছেন চিকিৎসক দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। বহু রোগীকেই সুস্থ করে বাড়ি পাঠাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করেই সতর্ক হতে হবে। এটাই 'মরাল অফ দ্য স্টোরি'।
অনুলিখন: নিবেদিতা বন্দ্যোপাধ্যায়