হিঙ্গলগঞ্জ: চোখে মুখে এখনও সেই শঙ্কার ছবি। ডাসা নদীর এক প্রান্তে বারবার ঘুরে ফিরে আসে সেই স্মৃতি। নিজের বলতে ছিল মাথার উপরের ছাদটা। কিন্তু একবছর আগের সেই সকাল সেটাও কেড়ে নিয়েছে। কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে এখন বাস অন্যের ভিটেতে। কোনও দিন পাতে এক মুঠো ভাত জুটলেও, ওবেলা কী খাবেন তা জানেন না ডাসা নদীর পাড়ের বাসিন্দারা।  নদীর পাড় থেকে ঠিকানা সরে গিয়েছে আগেই। তাণ্ডবলীলার একবছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেননি তাঁরা। আমফানের ভয়ের স্মৃতি উস্কে এখন তাঁদের একটাই দাবি, ফিরে যেতে চাই নিজের বাড়িতে।


গত বছর মে মাসের এমনই এক দিনে তাণ্ডব চালিয়েছিল আমফান। কালো মেঘ, বৃষ্টি সঙ্গে ঝড়ের ভ্রুকুটি বদলে দিয়েছিল প্রকৃতির চেনা ছবি। পাল্টে গিয়েছিল জীবনের গতি প্রকৃতিও। উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ এলাকার ডাসা নদীর জল ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে ঘটনার আগের রাতেই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে উঁচু জায়াগায় চলে যেতে বাধ্য হন হিঙ্গলগঞ্জের একাধিক অঞ্চলের বাসিন্দারা। দূর থেকে সেদিন তাঁরা দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন কীভাবে ভাঙছে নদীর বাঁধ। কীভাবে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের মাথার উপরের ছাদটা। জীবনের সঙ্গে সেই চরম লড়াইয়ের আজ একবছর। সেই বিধ্বংসী দিনের গল্প শোনাতে গিয়ে আজও চোখে মুখে ভয়ের ছাপ হিঙ্গলগঞ্জবাসীর। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন,  ঝড়ের খবর পেয়ে চলে আসি উঁচু জায়গায়। যাতে অন্তত প্রাণটা বাঁচে। কিন্তু এক বছর হয়ে গেল এখনও আমরা একসঙ্গে থাকছি অন্যের ভিটেতে। করোনার জন্য কাজ নেই। এই অবস্থায় সরকার পাশে দাঁড়ালে সুরাহা হয়।


এই ছবি হিঙ্গলগঞ্জের হেমনগর, বাইনারা, যোগেশগঞ্জ এবং দুলদুলি এলাকার। মাথার উপর এখন রয়েছে ত্রিপল। কারোর বা জুটেছে খড়। ব্যস ওইটুকুই একবছর আগের ২০ মে তাঁবুতে এনে রেখেছে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকার একাধিক মানুষকে। সেই তাঁবুরও অনেকটাই ছিঁড়ে গিয়েছে। নিজেদের বাড়ি, জমি বলতে আর কিছুই নেই। একই উঠোনে বাস একাধিক পরিবারের। রোজকার খাওয়া দাওয়া বলতে এক মুঠো ভাত। কোনওদিন তাও জোটে না। পেশা বলতে ছিল রাজমিস্ত্রীর কাজ, কেউ বা বনের মধ্যে যান কাঠ কাটতে। করোনার জেরে সেই পেশায় কোপ পড়েছে আগেই। অর্থাভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি বাড়ি। অভিযোগ, সরকারি ক্ষতিপূরণও অনেকেই পাননি।


 



এই রকম তাঁবুতে থাকছেন ডাসা নদীর পাড়ের বাসিন্দারা


কারোর কোলে সন্তান। কারোর আবার ঘরে রয়েছেন অসুস্থ বাবা মা। করোনাকালে মাস্ক কেনার মতো সামর্থ নেই। স্থানীয়রা বলছেন, এখনও শেষ হয়নি বাঁধের কাজ। তাই ডাসা নদীর পাড়ে যে বাস ছিল সেখানে ফিরতে পারব না। একাংশের আবার অভিযোগ, সরকার সাহায্য়ের জন্য যে টাকা পাঠিয়েছিল সেটাও অনেকেই পাননি। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য নথি সহ ছবি জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ৪ বার ছবি তুলে সব কাগজ জমা দিয়েছে। কিন্তু এখনও কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। যদিও স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, ভোটের জন্য বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল কাজ। তবে এখন বহু মানুষই নিজের পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়েছেন। হিঙ্গলগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক দেবেশ মণ্ডল বলেন, যাঁরা প্রথমে ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি তাঁদের পরে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এই রকম কোনও অভিযোগ পাইনি। যদি কোনও অভিযোগ জমা পড়ে বা তথ্য পাই তাহলে তা প্রতিকার করব এবং  অবশ্যই পাশে দাঁড়াব। হিঙ্গলগঞ্জের রুপোমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের মহাত্মা গাঁধী ন্যাশনাল রুরাল ডেভলপমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক গৌর মণ্ডল বলেন, গত বছর আমফানের সময় অনেকের ঘর বাড়ি ভেঙে গিয়েছিল। তারপর কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। ভোটের জন্য কাজ বন্ধ থাকলেও, এখন প্রায় সবাই নিজেদের বাড়ি পেয়ে গিয়েছেন।


কিন্তু আসল ছবি কী? প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া একটা ঘর। কোনওটা বা মাটির এক চালার। মাথার উপর খড় নেই। রয়েছে ত্রিপল। এভাবেই কেটে গিয়েছে একটা বর্ষা, একটা শীত। আসতে চলেছে আরও একটা বর্ষাকাল। হেমনগর অঞ্চলের বাসিন্দা কবিতা সরকার বলেন, আমার স্বামী প্রতিবন্ধী। সব কাগজ জমা দিয়েছিলাম । কিন্তু ক্ষতিপূরণের কোনও টাকা পাইনি। ত্রাণের যে জিনিস দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খেয়ে বেঁচেছি। কিন্তু এখন সেটার উপায় নেই। জমানো টাকাও বলতেও আর কিছু নেই। অন্তত সরকারি সাহায্য পেলে নিজেদের ঘরটুকু পেতাম। বায়নারা অঞ্চলের বাসিন্দা ছন্দা সরকার। করোনা আবহে মাস্ক কেনার মতো সামর্থ নেই। মুখে কাপড় বেঁধেই কাটছে দিন। তাঁর কথায়, ঘর তৈরির সামর্থ নেই। যেখানে আমাদের ঘর ছিল সেখানে এখনও জল রয়েছে। মাটি ফেলা হয়নি। তাঁবু খাটিয়ে নিজেদের জায়গায় থাকব, সেটার উপাও নেই।


আবারও একটা মে মাস। পেরিয়ে গেল আরও একটা ২০ মে। সেদিনের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। বদলে গিয়েছিল বেঁচে থাকার সমীকরণ। আশা ছিল, অন্তত বর্ষ পূর্তিতে দেখা যাবে নতুন সূর্য। তাঁরা ফিরে পাবেন নিজেদের হারিয়ে যাওয়া সেই ঠিকানা। পরিস্থিতির এমন নির্মম পরিহাস যে সেই স্বপ্ন এখনও অধরাই। তবে আশা বুক বেঁধে আছে ডাসা নদীর পাড়ের বাসিন্দারা। এই কঠিন লড়াইয়ে পাশে এসে দাঁড়াক সরকার। নদীর এপ্রান্তে দাঁড়িয়েই এখন এটাই কাতর আর্জি হেমনগর, বাইনারা, যোগেশগঞ্জ এবং দুলদুলি এলাকার বাসিন্দাদের।