নয়াদিল্লি: যুদ্ধ বয়ে আনে বিপর্যয়, যুদ্ধ বয়ে আনে মৃত্যু, যুদ্ধ বয়ে আনে বিভাজন। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এতদিনে বিষয়টি প্রমাণিত। কিন্তু তার পরও যুদ্ধের অভিশাপ ঘোচার কোনও লক্ষণ আপাতত নেই। রাশিয়া বনাম ইউক্রেন এবং ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধের মধ্যেই যুদ্ধ বৃহত্তর আকার নিতে শুরু করেছে পশ্চিম এশিয়ায়। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একজোটে হামলা চালাতে প্রস্তুত ইরান, লেবাননের হেজবোল্লা এবং ইয়েমেনের হুথি সংগঠন। এর পাল্টা,ইজরায়েলকে ‘রক্ষা’ করতে নেমে পড়েছে আমেরিকা। একে একে যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এবং অতিরিক্ত বাহিনী নামাতে শুরু করেছে তারা। এক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মহল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, যার এক দিকে রয়েছে, ইজরায়েল নেতৃত্বাধীন অ্যাব্রাহাম জোট এবং অন্যদিকে, ইরান নেতৃত্বাধীন অ্যাক্সিস অফ রেসিসট্যান্স বা প্রতিরোধী অক্ষশক্তি। (Iran Israel War)
পশ্চিম এশিয়ায় বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে দীর্ঘ ন’মাস ব্যাপী ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধ। গতবছর ৭ অক্টোবর প্যালেস্তিনীয় সংগঠন হামাসের তরফে ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রথম রকেট ছোড়া হয়। এর পাল্টা প্যালেস্তাইনকে কার্যত মাটিতে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইজরায়েল। গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে লাগাতার হতাহত বেড়ে চলেছে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের। পৃথিবীর বহু দেশই ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কিন্তু মহা শক্তিধর আমেরিকা বন্ধুদেশ ইজরায়েলের পক্ষ নিয়ে চলেছে এখনও পর্যন্ত। ইরান হামলার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর, একরকম যেচে পড়েই ইজরায়েলকে ‘রক্ষা’ করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে আমেরিকা। (Israel Hamas War)
আর এই আবহেই পশ্চিম এশিয়ায় বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গতমাসে আমেরিকার কংগ্রেসে ভাষণ দেন নেতানিয়াহু। সেখানে পশ্চিম এশিয়ায় আঞ্চলিক জোটের কথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন তিনি। ইজরায়েল নেতৃত্বাধীন জোটকে ‘অ্যাব্রাহাম জোট’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার যে সমস্ত দেশের, তাদের নিয়ে অ্যাব্রাহাম জোট গড়ে উঠেছে। অন্য দিকে, ইরান নেতৃত্বাধীন কিছু দেশ এবং ইরানের মদতপুষ্ট কিছু সংগঠনকে নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রতিরোধী অক্ষশক্তি।
অ্যাব্রাহাম জোট
২০২০ সালে অ্যাব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় ইজরায়েলের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তিতে সম্মত হয় আরব দুনিয়ার একাধিক দেশ, যার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন, মরক্কো, সুদানের মতো দেশ রয়েছে। শুধু বর্তমানেই নয়, আগামী দিনেই পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রাখার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তারা। নেতানিয়াহুর দাবি, ইরানের ‘সন্ত্রাসে’র মোকাবিলা করতেই এই জোট। এ ব্যাপারে আমেরিকাকে পাশে পেতেও চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না নেতানিয়াহু। যে কারণে আমেরিকার কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন উইনস্টন চার্চিলের একটি মন্তব্যও তুলে ধরেন, যেখানে আমেরিকার উদ্দেশে চার্চিলের বক্তব্য ছিল, “আমাদের শুধু সরঞ্জাম দাও, কাজ শেষ করে দেখাব।” ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের জন্য অতিরিক্ত সরঞ্জাম এবং বাহিনী নামাতে শুরু করেছে পেন্টাগন। ব্রিটেনের সঙ্গেও কথা চলছে ইজরায়েলের।
প্রতিরোধী অক্ষশক্তি
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছে ইরান। প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে একাধিক সশস্ত্র সংগঠনকে মদত জোগায় তারা। সেই তালিকায় রয়েছে, লেবাননের হেজবোল্লা, ইয়েমেনের হুথি, ইরাক, সিরিয়া এবং গাজার সশস্ত্র সংগঠনগুলিকেও সাহায্য় জোগায় তারা। শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে পশ্চিম এশিয়ায় রীতিমতো নেটওয়র্ক গড়ে তুলেছে ইরান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হেজবোল্লা। আটের দশকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে লাগাতার ওই সংগঠনকে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পসই অস্ত্রশস্ত্র জুগিয়ে আসছে বলে অভিযোগ। হেজবোল্লাও ইরানের মতো শিয়াপন্থী, লেবানন থেকে তারা শিয়াপন্থীদেরই নিয়োগ করে। লেবাননে ইজরায়েলি সেনাকে প্রতিহত করতেই হেজবোল্লার প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু বর্তমানে হেজবোল্লা একটি সশস্ত্র সংগঠন, লেবাননের রাজনীতিতেও প্রভাব রয়েছে তাদের। হেজবোল্লার কাছে কমপক্ষে ১ লক্ষ ৩০ হাজার রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
প্য়ালেস্তাইনের গাজায় হামাস এবং প্যালেস্তাইন ইসলামিক জিহাদ, এই দু’টি সংগঠনকেই ইরান সহযোগিতা জোগায়। ইরান থেকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য় যায় তাদের কাছে, যাতে বলীয়ান হয়েই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ওই দুই সংগঠন। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছে ইরান। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেই সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে। আসাদ সরকারকে ইরান কমপক্ষে ৮০ হাজার সৈন্য, সামরিক সাহায্য় জুগিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এমনকি আসাদের হাত শক্ত করতে সিরিয়ার একাধিক শিয়া শক্তিকেও সাহায্য করে ইরান। নয়ের দশকে ইয়েমেনের হুথি-র প্রতিষ্ঠা হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে উত্থান শুরু তাদের। ইরানই তাদের সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য় জোগায় বলে অভিযোগ। এর পাশাপাশি, ২০১১ সালে আমেরিকা ইরাকে আক্রমণ চালাে, সেখানকার সশস্ত্র শিয়া সংগঠনগুলিকে সাহায্য জোগাতে শুরু করে আমেরিকা। সেই তালিকায় রয়েছে কতাইব হেজবোল্লা, আসাইব আহল আল-হক, বদর সংগঠন। ইরানের সঙ্গে এই সংগঠনগুলি লাগাতার সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।