রবিবারের দুপুর । কার্যত বিশ্রামের সময়। এছাড়া সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সবথেকে স্বাভাবিক অঙ্গ 'পরিবার'-এর সঙ্গে অলস সময় কাটানোর। এর সাথে আবার ইউরো ২০২০-র ফাইনালে ইংল্যান্ড বনাম ইতালির দ্বৈরথ জুড়ে গেলে তার থেকে ভাল অবসর যাপন আর কি হতে পারে ! দীর্ঘ ট্রফি খরার পর দুই দেশ গতকাল মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে শেষবার ইতালি এই কাপ জিতেছিল। অন্যদিকে ইংল্যান্ড শেষবার কোনও বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতেছে ১৯৬৬ সালে। ৪-২ গোলে জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা। ইংল্যান্ড কখনও ইউরো কাপ জেতেনি। ইংল্যান্ড ফুটবলের দেশ। ইংল্যান্ডের ফুটবল ভক্তদের কুখ্যাতি রয়েছে। আমেরিকার সাংবাদিক বিল বুফোর্ড ১৯৯০ সালে ফুটবলে গুণ্ডাগিরি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। অ্যামোং দ্য থাগস। যাতে মূলত ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ফুটবল ফ্যানদের কথা বলা আছে। যাঁদের সাথে তিনি অনেক ম্যাচ ঘুরে বেরিয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, এই 'গুণ্ডাদের' তাঁদের দলের প্রতি ভক্তি অপিরসীম। এটা কার্যত 'ধর্ম' তাঁদের কাছে। বুফোর্ড একবার এই ফুটবল ভক্তদের মধ্যে অশান্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে সার্ডিনিয়ায়। সেখানে বিশ্বকাপের খেলা হচ্ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি দেখেন এই অশান্তি "সুখদায়ক"।


রবিবারের দুপুরে আমার লস অ্যাঞ্জেলসের বাড়িতে বসে ইউরো কাপ দেখছিলাম। এটা একধনের অবসরের বিকেল। সুন্দর এই খেলাটির অনুসরণকারী ছাড়া, বিশ্বের চোখে যাঁরা ভক্ত, আমি তাঁদের থেকে অনেক দূরে বা ফুটবল পাগলও নই। কী করে কেউ কোনও টিমের ভক্ত হয়ে ওঠেন তা রহস্যজনক। এমন ভক্ত হয়ে ওঠেন যে গলা খুলে চিৎকার করতে পারেন, বিয়ারের বোতল ছুঁড়তে পারেন, মারামারি করতে পারেন, এমনকী ভাঙচুরও চালাতে পারেন। এটা কি করে সম্ভব তা আমার কাছে দুর্বোধ্য। গতকাল ওয়েম্বলিতেও তাই হয়েছে। কয়েক হাজার ইংরেজ ফ্যান টিকিট ছাড়াই স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েছিলেন। কয়েকজনকে মারধর করে, ভাঙচুর চালান। বাফোর্ডের কথায়, খেলা শুরু হওয়ার উত্তেজনায় তাঁরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। রবিবারের অবসরের দিনে আমার কাছেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। প্রায় তিন ঘণ্টার টান টান উত্তেজনা। ১-১ এ ড্র হওয়ার পর পেনাল্টি কিকে শেষমেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয় ইতালি। 


ইংল্যান্ডের কি ফাইনালে ওঠা উচিত তা নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিল। ডেনমার্কের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ম্যাচে তাদের যে পেনাল্টি কিক দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে শুধু আমার মধ্যেই প্রশ্ন ছিল না। এটা রেড কার্ড দেখানোর মতো ফাউল ছিল। আমার মধ্যে রয়েছে সেই ভারতীয় সত্ত্বা। যে চিরকাল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ছাত্র। ইংল্যান্ডকে এমন একটা দেশ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত যারা 'ফেয়ার প্লে'র কথা বোঝে না এবং কখনও ভারতীয় শাসকদের সঙ্গে হওয়া চুক্তিকে সম্মান জানায়নি। যার জেরে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের মাথায় হাত দিয়ে বসে। আমেরিকায় থাকা ব্রিটেনের এই ভাইেয়রা শুধুমাত্র ভারতীয়দের সঙ্গেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে তা নয়, আমেরিকাবাসীর সঙ্গেও এমনটা করেছে। তাদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেছে। তা সত্ত্বেও বলব, ইংল্যান্ড যদি কোনও পেনাল্টি 'পুরস্কার' হিসেবে পায়, তবে তা রেফারির ভুল বিশ্লেষণের জেরে। আরাম-কেদারায় আরাম করে বসেছিলাম এই ভেবে যে ইতালি জিতবে। যদিও আমি ইতালি বা ইংল্যান্ডের ভক্ত নই। ইংল্যান্ড ও অন্য দেশের মধ্যে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে, আমি সাধারণত আবেগের আশ্রয় নিই। যা মার্ক মার্কিজের ক্রিকেট, বর্ণবিদ্বেষ ও জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত বই "এনিওয়ান বাট ইংল্যান্ড"(২০০৫) বইয়ে আছে। এর ব্যতিক্রমও আছে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাছতে হলে, আমি ইংল্যান্ডের পক্ষে যাব। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার ভয়ংকর বর্ণবিদ্বেষ ও ফিলিস্তিনিজম আরও বিস্বাদের।


খেলার দুই মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার লিউক শ তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করে ফেলেন। ইউরো ফাইনালের ইতিহাসে দ্রুতগামী গোলও এটা। ভাল গোল ছিল এটা। কষ্টার্জিতও। এর পর থেকেই আমার হৃস্পন্দন বেড়ে যায়। কিন্তু, আমি ফুটবল-গুণ্ডা নই। এমনকী ভক্তও নই। মনে নানা চিন্তা আসছিল। যদি ইংল্যান্ড জিতে যেত, তাহলে ব্রেক্সিটের রক্ষকরা দাবি করতেন, ইউরোপিয় ইউনিউন থেকে বেরিয়ে এসে ইংল্যান্ডের ফুটবলকেও বাঁচিয়ে তোলা গেছে। কিন্তু, ইংল্যান্ডের জয়ের সঙ্গে ব্রেক্সিটের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকা নিয়ে প্রশ্ন নয়। এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁরা এটা ভেবে বিভ্রান্ত নন যে যুক্তিপূর্ণ আবেদনে বিশ্বকে আদেশ দেওয়া যায়।


প্রথম আধ ঘণ্টা ইংল্যান্ড খেলার রাশ ধরে রেখেছিল। কিন্তু, ধীরে ধীরে ইংল্যান্ড এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়ে যে, লিড বাড়ানো নয়, প্রতিরক্ষার দিকে নজর দেওয়া ঠিক হবে। আমার ভীষণ এটা বলতে ইচ্ছা করছিল যে, কেউ একজন গিয়ে ইংল্যান্ডের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটকে বলে আসুক যে, তাঁর দেশ কোনও সাম্রাজ্য লাভ করেনি। এবং ইউনিয়ন জ্যাককে অর্ধ বিশ্বজুড়ে ওড়াতে হবে। কিন্তু, ফুটবল সাম্রাজ্য বিস্তারের মতোই পরিবর্তনশীল খেলা। শেষে দুই-তৃতীয়াংশ সময়ে খেলার রাশ ধরে ইতালি। ইতালির বল ধরে রাখাটাই এই গল্পের অর্ধেকটা বলে দিচ্ছে। কিন্তু, এটা আমাদের ফুটবলের সাংস্কৃতিক রাজনীতির কথা বলে না। ৬৭ মিনিটের মাথায় বিখ্যাত ডিফেন্ডার বোনুচ্চি খেলার ফল ১-১ করে ফেলেন। এরপর ৩০ মিনিটের অতিরিক্ত খেলা। সেখান থেকে পেনাল্টি শ্যুটআউট। 


যদি সাধারণ খেলা ও অতিরিক্ত সময় হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে পেনাল্টি শ্যুটআউট চিন্তা-উদ্রেককারী এবং কারও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পেনাল্টি শ্যুটআউট নিয়ে আরও বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। যদিও এক্ষেত্রে কোনও খেলোয়াড়কে পেনাল্টি বা 'শাস্তি' দেওয়া হয় না। যদিও পেনাল্টি শ্যুটআউট একধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। খেলা শেষ করার পক্ষে খুব উদ্ভট একটা পথ। বলতে গেলে, এর মাধ্যমে খেলোয়াড়দেরই পেনাল্টি বা 'শাস্তি' দেওয়া হয়। ব্যর্থ হওয়ার শাস্তি চাপানো হয় তাঁদের উপর। অন্যদিকে দর্শকদের ক্ষেত্রেও "পেনাল্টি শ্যুট আউট" এক ধরনের শাস্তির মতোই। প্রত্যেকেই বোঝে যে, এটা এক ধরনের ভাগ্যের বিষয়।


সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই পেনাল্টি শ্যুটআউট সবথেকে হৃদয়-বিদারক বিষয়। একবার ফল দেখে নেওয়া যাক। ইতালি ৩, ইংল্যান্ড ২। কোচ সাউথগেট দুই খেলোয়াড়ের বিকল্প পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।  খেলার একদম শেষ দিকে। এই পরিকল্পনা থেকে যাতে তাঁরা পেনাল্টি কিক নিতে পারেন। এভাবে পেনাল্টির সুযোগ পাওয়া পাঁচ খেলোয়াড়ের মধ্যে দুজনের পা একদম সতেজ(ফুটবলের ভাষায়)। তৃতীয়জন কিশোর। যে আগেও কখনও আন্তর্জাতিক ম্য়াচে পেনাল্টি মারেনি। দুটি পেনাল্টির শেষে ইংল্যান্ড ২-১ এ এগিয়ে ছিল ইতালির থেকে। কিন্তু, ইতালির গোলকিপার স্যাঞ্চোর পেনাল্টি সেভ করার পর স্কোর সমান হয়ে যায়। এরপর র্যাশফোর্ড পোস্টে পাঠায় বলকে। ইংল্যান্ডের পুরো ভার এসে পড়ে নরম কাঁধ সাকার ওপর। এমনকী এই সময়ে ইতালির পেনাল্টি এক্সপার্ট জরগিনহোও ব্যর্থ হন। এই সময়ে অন্য দলের ব্যর্থতার বিষয়টি মাথায় নেন না ভক্তরা। তাঁরা শুধু নিজের দলের ফলাফলের কথা ভাবতে থাকেন। কী হতে চলেছে সেটাই তাঁদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এরপর থেকে সাকার অনভিজ্ঞতা, ইতালির গোলকিপারের হিরোইজম এবং কোচের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে এলোপাথাড়ি আলোচনা চলবে। কেউ এই আলোচনাটা করবে না যে, সাকা যদি বলটা গোলে জড়াতে পারতেন, তাহলে ইংল্যান্ড স্কোর লেভেল করে ফেলত। আর তার ফলে খেলা চলে যেত "সাডেন ডেথ"-এ।


র্যাশফোর্ড, স্যাঞ্চো এবং সাকা- প্রত্যেকেই  রঙিন খেলোয়াড়। ইংল্যান্ডের পরাজয়ের কিছুক্ষণের মধ্যেই এই তিনজনই সোশ্যাল মিডিয়ায় গালাগালির পাত্র হয়ে উঠেছেন। সাকা নাইজেরিয়া বংশোদ্ভূত। কিন্তু, ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু, তাতে কিছু ভক্তকে এটা বলা থামাতে পারবে না যে, তাঁকে(সাকাকে) নাইজেরিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। ইংল্যান্ডে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্য়াকাউন্টে বাঁদরের ছবি দেওয়া ইমোজি ভেসে বেড়াচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন কড়া বিবৃতি জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংল্যান্ডের কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে যে বর্ণবিদ্বেষমূলক কথাবার্তা চলছে তাতে সংস্থা পুরোপুরি হতবাক। এই ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। ফুটবলের মাঠে বাঁদরের চিৎকারের লম্বা ইতিহাস আছে ইংল্যান্ডে। ইউরোপের অন্য প্রান্তেও। যদিও বর্ণবিদ্বেষ উৎখাত করতে কতটা কাজ করা এখনও বাকি আছে তা নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে, আমি বলতে চাই কেন ইংল্যান্ডের পরাজয়ের আশা করার সময়ে ইতালিরও জয় আশা করিনি। ফুটবলকে কখনও কখনও বলে হয় "সুন্দর খেলা"। অন্য কোনও খেলার এমন বিশ্বজনীন আবেদন নেই। এটা ইংল্যান্ডের কৃতিত্ব যে, সেখানে জাতীয় দলে র্যাশপোর্ড, স্যাঞ্চো ও সাকা নিজের নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছেন। অন্যদিকে ইতালির জাতীয় দল দ্য আজ্জুরি, একদম প্রাদেশিকতায় ভরা। ২০২১-এও একজন পেতে পারে শুধু মানচিনি, বোনুচ্চি, চিল্লিনি অথবা লোরেঞ্জো, স্পিনাজ্জোলা এবং বার্নারদেস্চিকে। ইতালিতে নবজাগরণের জন্ম হতে পারে, কিন্তু এখানকার ফুটবল দল প্রথমদিককার সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন। 


যদিও ফুটবলের ভবিষ্যৎ ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি বা স্পেন. ডেনমার্ক বা ফ্রান্স নয়। বা কোনও জাতীয় দল নয়। যে কোনও খেলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা কতটা সভ্য হয়েছি তার উপর বা যখন আমরা জয়-পরাজয়ের কথা ভাবা বন্ধ করে দেব তখনকার উপর।