নয়াদিল্লি: কার্ল মার্কস এবং লেনিনের নাম মিলিয়ে ‘মিডল নেম’ রেখেছিলেন মা-বাবা। দীর্ঘ সময় সেটি ব্যবহারও করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাননি বলে নিজেই সেটি বাদ দিয়েছিলেন। অতিশী মারলেনার পরিবর্তে, শুধুমাত্র অতিশী লিখতে শুরু করেন। কিন্তু দিল্লি তথা দেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে কার্যত আম আদমি পার্টির ধারক-বাহকে পরিণত হলেন অতিশী। বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হয়েছে। দলের প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল-সহ হেভিওয়েট নেতারা নিজের কেন্দ্র পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। এই বিপর্যয়ের সময় দলের মুখরক্ষা করেছেন অতিশী। কালকাজি আসনে বিজেপি-র রমেশ বিদুরিকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন তিনি। এই নির্বাচন অতিশীর কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে পারে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। (Atishi Political Rise)

Continues below advertisement

নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর এদিন নিজের কেন্দ্রে সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান অতিশী। সাধারণ মানুষের মাঝে হাজির হন। কিন্তু জয়ের মুহূর্তে আনন্দের চেয়ে বিষাদের সুরই শোনা গেল তাঁর গলায়। অতিশীর বক্তব্য, “কালকাজির মানুষকে ধন্যবাদ। আমার উপর আস্থা রেখেছেন ওঁরা। আমার গোটা টিমকে ধন্যবাদ। বাহুবল, গুন্ডামি, মারপিট সত্ত্বেও মাটি কামড়ে লড়াই করেছে, মানুষের কাছে পৌঁছেছে। জনাদেশ স্বীকার করছি। আমি জিতলেও এটা উদযাপনের সময় নয়। এটা যুদ্ধেরই সময়। যুদ্ধ চলবে। বিজেপি-র বিরুদ্ধে, তানাশাহির বিরুদ্ধে, গুন্ডামির বিরুদ্ধে জয়ী হতে হবে। আম আদমি পার্টি বরাবর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, আগামীতেও করবে। এটা একটা ধাক্কা অবশ্যই। কিন্তু দিল্লিবাসী এবং দেশবাসীর জন্য সংঘর্ষ চলবে আমাদের।” (Delhi Election Results 2025)

নিজের কেন্দ্র নয়াদিল্লিতে পরাজিত হয়েছেন কেজরিওয়াল। প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসৌদিয়া, প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনও পরাজিত হয়েছেন। তাই অতিশীর জয় আম আদমি পার্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনে দিল্লি বিধানসভায় কেজরিওয়াল, সিসৌদিয়াদের অনুপস্থিতিতে দলকে তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাই বিষাদের মধ্যেও আশার আলো দেখছেন সমর্থকদের অনেকে। এই নির্বাচন অতিশীকে নেত্রী হিসেবে আরও পরিণত করবে, বিজেপি বিরোধী শিবিরে মহিলা রাজনীতিক হিসেবে দেশের রাজনীতিতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

Continues below advertisement

২০১৩ সালে আম আদমি পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন অতিশী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলম থেকে জন্ম দলের, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দলের নীতি-নির্ধারণের দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৯ সালে দলের হয়ে পূর্ব দিল্লি থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু বিজেপি-র গৌতম গম্ভীর তাঁকে পরাজিত করেন। ২০২০ সালে কালকাজি থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন অতিশী। কেজরিওয়ালের মন্ত্রিসভাতেও জায়গায় পেয়ে যান। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শিশুশিক্ষায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। দিল্লির জলসঙ্কট সামাল দিতেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু অতিশীর রাজনৈতিক জীবনের সন্ধি ক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটি। আবগারি মামলায় জেল খেটে বাইরে বেরনোর পর মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণা করেন কেজরিওয়াল। তাঁর জায়গায় অভিষিক্ত হন অতিশী। ৪৩ বছর বয়সে দিল্লির সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পদে আসীন হন। কেজরিওয়ালের চেয়ারটি খালি রেখে, পাশের চেয়ারে বসেই সাময়িক ভাবে দিল্লির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। সঙ্কটের সময় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়ার সময় কেজরিওয়াল জানিয়েছিলেন, মানুষের হাতেই বিচারের ভার ছেড়ে দিলেন তিনি। দুর্নীতি মামলায় তিনি যুক্ত কি না, তার বিচার করতে হবে মানুষকেই। মানুষ যদি জিতিয়ে আনেন তাঁকে, তবেই ফের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ওঠে, নিজের জায়গা অতিশীকে এমনি এমনি ছেড়ে দেননি কেজরিওয়াল। ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলেই সাময়িক অব্যাহতি নিয়েছেন। ভোটের বৈতরণী পার হলে ফের নিজেই ক্ষমতায় আসীন হবেন। 

কিন্তু দিল্লির মানুষ যে কেজরিওয়ালের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তা বোঝা যায় শনিবার ভোটগণনা শুরু হওয়ার পর পরই। তর তর করে আম আদমি পার্টির থেকে এগিয়ে যেতে শুরু করে বিজেপি। অতিশীকেও তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়। বিজেপি-র রমেশ এবং কংগ্রেসের অলকা লম্বা কড়া টক্কর দেন তিনি। শেষ পর্যন্ত স্বল্প ব্যবধানে হলেও উতরে যান অতিশী। কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, ক্ষমতার লোভে রাজনীতিতে আসেননি তাঁরা। আগামী দিনেও মানুষের সেবা করে যাবেন, বিরোধী দল হিসেবে গঠন ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় বিরোধী নেতা হিসেবে বিধানসভায় হাজির থাকতে দেখা যাবে না কেজরিওয়ালকে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সিনিয়র নেত্রী হিসেবে অতিশীকেই সেখানে নেতৃত্ব দিতে হবে দলকে। তাই দলের অন্দরেও 'ওজন' বাড়বে তাঁর। 

মহিলা নেত্রী হিসেবেও অতিশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এবারের নির্বাচনেই যা পূর্বাভাস মেলে। নির্বাচনী প্রচারে যখন কুকথার ফোয়ারা ছুটছে, সেই সময় অতিশীর নাম নিয়ে অশালীন আক্রমণ শানান বিজেপি-র রমেশ। তাঁকে বলতে শোনা যায়, 'মারলেনা এখন সিংহ হয়েছেন। বাবা পাল্টে ফেলেছেন (অতিশী)। আগে ছিলেন মারলেনা। এখন সিংহ'। রমেশের ওই মন্তব্যের পর প্রকাশ্যে ভেঙে পড়েন অতিশী। সেই সময় সাধারণ মানুষের সমর্থনও কুড়িয়েছিলেন তিনি। তাই মহিলা রাজনীতিক হিসেবেও জনসংখ্যার বড় অংশের সমর্থন তাঁর সঙ্গে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।