গত ১৮ই জানুয়ারি আমরা প্রত্যক্ষ করলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী জনমত-সমীক্ষা। সামনের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমে এটিই প্রথম। সারমর্ম যা জানা গেল তাতে গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে মোটের ওপর ভোট শতাংশ প্রায় একই আছে সব দলের। সামান্য দু শতাংশ ভোট কম দেখা যাচ্ছে বিজেপির ক্ষেত্রে। সাধারণভাবে চল্লিশ শতাংশের কাছাকাছি ভোট যে সব দল পান, তাদের ক্ষেত্রে জনমত সমীক্ষায় ভোট শতাংশের অনুমানে খুব বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। ভালোভাবে হাজার পাঁচেক মানুষের কাছ থেকে সৎ মতামত নিতে পারলেই অনুমান বাস্তবের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মোটের ওপর কম-বেশি তিন শতাংশ ভুল মেনে নেওয়া হয় এই ফলাফলে। সেই হিসেবে ৪৩-কে মাঝামাঝি ধরে তৃণমূল পেতে পারে ৪০ থেকে ৪৬ শতাংশ ভোট। আর ৩৮-কে মধ্যে রাখলে বিজেপির ভাগে ৩৫ থেকে ৪১। অর্থাৎ এই ফলাফলের নিরিখে এখন থেকেই সবটুকু বুঝে নেওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গে আরও একটি বিষয় মনে করানো প্রয়োজন। এই কথাটি আমরা বারবার বলি, কারণ সমাজবিজ্ঞান অঙ্ক নয় যে একবার লিখে দিলেই সকলে মনে রাখবেন। এখানে রাজনৈতিক দলের নেতা একই কথা বলেন কয়েকশো সমাবেশে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক পুরনো যুক্তি শানান মরচে সরিয়ে। সেইরকমই বঙ্গের রাজনীতিপ্রিয় মানুষকে সকাল বিকেল মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে ভোট শতাংশের হিসেব থেকে আসনে যাওয়া ভীষণ কঠিন, হয়ত বা অসম্ভবও বটে। এখানটায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অর্থাৎ সোজা কথায় বাম-কংগ্রেস জোট বারো শতাংশ ভোট পেয়ে দশ শতাংশ আসন কিভাবে পেতে পারেন, সেই আলোচনাও খুব সাবধানে করা প্রয়োজন। এবারের নির্বাচনে বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসমর্থন যে একই মাত্রায় বিন্যস্ত নয়, সেটাও বোঝা যাচ্ছে এই সংখ্যা থেকে। এই সমীক্ষায় তৃণমূলের আসন সংখ্যা পাওয়া গেছে তাদের ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভার হিসেবে প্রাপ্ত আসনের কাছাকাছি। বিজেপির ক্ষেত্রে তা খান কুড়ি মতন কমেছে আর সেটা যোগ হয়েছে বাম-কংগ্রেসের ঝুলিতে। সামনের দিনগুলোতে এরকম আরও পাঁচটা সমীক্ষার ফলাফল জানাবে এবিপি আনন্দ। সেগুলোর দিকে নজর রাখলে অবশ্যই গতিপ্রকৃতি কিছুটা বোঝা যাবে নির্বাচনের। তবে এটা সবসময়েই মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনী জনমত কিংবা বুথফেরত সমীক্ষাতে ভুল হতেই পারে।


অন্যদিকে নির্বাচন সংক্রান্ত সমীক্ষার বিনোদনী মূল্য অত্যন্ত বেশি। বহু মানুষ অপেক্ষা করে থাকেন এই ধরণের সমীক্ষা প্রত্যক্ষ করার জন্যে। আর যেকোন গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিশ্লেষণের ওপর বাধা থাকার কথা নয়। বিশেষ করে যখন দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম বারবার মনে করিয়ে দেয় যে এই ভবিষ্যৎবাণী আগামী দিনে মিলতে নাও পারে। তবে এর বিরোধী মতও আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা, বিশেষ করে যাদের জন্যে সমীক্ষার ফল নেতিবাচক, তাঁরা মনে করেন এর মাধ্যমে প্রভাবিত করা হচ্ছে জনমত। অর্থাৎ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে যে ভাসমান ভোটার, তারা জয়ী দলের দিকে ঘুরে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এই নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বেশ কিছু, তবে সে তাত্ত্বিক আলোচনায় যাচ্ছি না। বরং একথা বলতেই হয়, এতদিন ধরে বিভিন্ন দেশে যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা থাকেই। উন্নত গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষ থাকাটাই দস্তুর। যদিও সেখানেও প্রচুর প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত বিতর্ক আছে। তবে দিনের শেষে গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে জনমতসমীক্ষা বিপজ্জনক একথা বলতে গেলে অনুসিদ্ধান্তে গণতন্ত্রের পক্ষে সংবাদমাধ্যম গোলমেলে ভূমিকা পালন করে এই জায়গায় পৌঁছে যেতে হবে। সেকথা মেনে নেওয়া শক্ত। রাজনীতির চাপে যতই নড়বড়ে হোক না কেন, সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। এই প্রসঙ্গে শাসকের কথাতেও আসতে হবে। শাসক মাত্রেই বিরোধীকে কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দেবে, সমালোচককে নিলডাউন। সেখানে বিভিন্ন রকমের শাস্তি ভয় থাকলেও সংবাদমাধ্যম বাধ্য ছাত্রছাত্রীতে বিবর্তিত হয় না। তাই ভালোমন্দ হিসেব করে এটুকু বোঝাই যায় যে কেন চিন কিংবা উত্তর কোরিয়ায় জনমতসমীক্ষা হয় না, আর ভারত কিংবা আমেরিকায় হয়।

জনমতসমীক্ষার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এখানে ফলিত রূপ পায় বিমূর্ত অঙ্ক। সরল পাটিগণিত থেকে স্নাতকস্তরের রাশিবিজ্ঞান, সবকিছু মিলেমিশে থাকে এই যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগে। এমনিতে বই খুলে অঙ্ক কষতে কারই বা ভাল লাগে? তুলনায় বাজারের দরাদরিতে পাটিগণিত অনেক বেশি মজার। সেই রকমই সন্ধেবেলার তর্কবিতর্কের সঙ্গে শতাংশ কিংবা আসনের অঙ্ক মিশলে বিষয়টা যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে একথা মাথায় রাখতেই হবে যে বাঙালিদের কাছে রাজনীতি যতটা প্রিয়, প্রায় ততটাই প্রিয় রাজনীতির অঙ্ক। পূর্ব মেদিনীপুরের কতগুলো আসন শুভেন্দুবাবুর দলবদলে তৃণমূল থেকে বিজেপির দিকে যেতে পারে সেই আলোচনা এখন অঙ্ক দেখলে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষও কষছে। অবশ্যই রাজনীতিতে রসায়ন আছে। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর মধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে তিনি নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন নন্দীগ্রাম এবং ভবানীপুর থেকে। একদিকে তাঁর নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়ানো অবশ্যই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার শ্লোগান। দল ভাঙার ক্ষতিকে যাতে কমিয়ে ফেলা যায় তার জন্যে আগাম প্রস্তুতি। নন্দীগ্রামের সভা থেকে দলের কর্মী-সমর্থকদের জন্যে লড়াইয়ের সুর বেঁধে দিয়েছেন তিনি। বিরোধীরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই আওয়াজ তুলবেন যে হারের ভয়ে একাধিক আসনে লড়াই করছেন নেত্রী। আর এই আলোচনার মাঝেও কিন্তু লুকিয়ে আছে অঙ্ক। কোন নেতানেত্রীর যদি একটি আসন থেকে জেতার সম্ভাবনা হয় ষাট শতাংশ, আর অন্যটি থেকে সত্তর, সেক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে যে একসঙ্গে দুটি আসনে লড়াই করলে অন্তত একটি আসনে জেতার সম্ভাবনা বেড়ে হয় অষ্টআশি শতাংশ। আবার শুভেন্দুবাবু বলেছেন যে বিজেপি থেকে যে-ই নন্দীগ্রামে ভোটে লড়ুন না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁরা আধ লক্ষ ভোটের ব্যবধানে হারাবেন। এখানেও সম্ভাবনার অঙ্ক, যদিও সে সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। একটি বিধানসভা কেন্দ্রের আড়াই-তিন লক্ষ ভোটারের মধ্যে সত্তর শতাংশ মানুষ ভোট দিলেও বড়জোর দুলক্ষ হয়। সেখানে পঞ্চাশ হাজারের ব্যবধানে রাজ্যের সবথেকে বড় নেত্রীকে হারানো নির্বাচনী শ্লোগান হিসেবে যতটা জোরালো, তথ্য বিশ্লেষণের অঙ্কে সে সম্ভাবনা একেবারেই কম।

শুভেন্দুবাবুর বিষয়ে আলোচনায় আরও কয়েকটি পর্যবেক্ষণের কথা লিখতেই হচ্ছে। প্রথম হল তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এই মুহূর্তে দলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বক্তা। যে কোন রোড-শো কিংবা সমাবেশে তাঁকেই দেখা যাচ্ছে মধ্যমণি হিসেবে। টেলিভিশনেও তাঁর বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে যথেষ্ট সময় নিয়ে। ফলে বিজেপি দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে মুখ্যমন্ত্রীর নাম স্থির না করলেও, একেবারে সামনের সারির নেতা হিসেবে শুভেন্দুবাবু যে বিজেপিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা বুঝতে কোন অসুবিধে নেই। দ্বিতীয় বিষয়টি হল তাঁর সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি জনসভায় প্রত্যক্ষভাবে সিপিএমের প্রশংসা। বুদ্ধদেববাবুকে সৎ নেতা হিসেবে মনে করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বাম আমলে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়মিত পরীক্ষার কথা আসছে তাঁর ভাষণে। অঙ্ক এখানেও খুব শক্ত নয়। দুহাজার ষোল থেকে ঊনিশের মধ্যে বাম সমর্থকদের যে কোটিখানেক ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল সেটাকে ধরে রাখা। কেন এই দিকটায় বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে? এর কারণ খুব পরিষ্কার। যে বাম সমর্থকরা বিজেপির দিকে ঘুরেছিলেন, তাদের মধ্যে তৃণমূল বিরোধিতা স্পষ্ট। এবার সেই তৃণমূলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা পৌঁছে গেছেন বিজেপিতে। এই প্রেক্ষিতে সেই সব মানুষদের একটা অংশ যদি বিরক্ত হয়ে আবার বামেদের দিকে ফিরে আসেন তাহলে বিপদ বিজেপির। অর্থাৎ তৃণমূল নেতার বিজেপিতে যাওয়ায় কিছু সংখ্যক ভোট হয়ত তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে একই বিরক্তিতে বিজেপির কিছু ভোট যদি বামেদের দিকে চলে আসে তাহলে আবার লাভের গুড় পিঁপড়ের পেটে চলে যাবে। অর্থাৎ যে কোন নেতার তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগদানের অঙ্কে যোগ বিয়োগ দুটোই থাকছে। সব মিলিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি এই দুটি দলেই আদি, নব্য এবং পরিযায়ী হিসেবে যে তিন ধরণের নেতানেত্রী এবং কার্যকর্তার সংজ্ঞা নির্ধারিত হচ্ছে তাতে ভোটের হাতবদল অনুমান করা জটিল হয়ে যাচ্ছে ভীষণভাবে।

সবশেষে বাম-তৃণমূল জোটের কথায় আসা যাক। রাজনীতিতে অবাক করার মত অনেক কিছুই ঘটে, তবে আপাতত সমীক্ষার হিসেব যা বলছে তাতে তাদের জনসমর্থন শতাংশ লোকসভা নির্বাচনের মতই রয়ে গেছে। ফলে তাদের ক্ষমতায় আশার সম্ভাবনে একেবারেই কম। একে দুদিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। এক, কেন্দ্রের শাসক বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক তৃণমূলের ওপর মানুষ বিরক্ত হলেও তারা এখনই দলে দলে ভোট দিয়ে তৃতীয় পক্ষকে জেতানোর কথা ভাবছে না। দুই, এবং তাদের পক্ষে ইতিবাচক বিষয় হল আর যাই হোক শেষ ভোটটুকু অন্তত অক্ষত আছে। লেখচিত্র আর নামছে না। বরং সমীক্ষার ফলে বিধানসভাভিত্তিক আসনের হিসেবে লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রচুর উন্নতি হয়েছে তাদের। লোকসভার হিসেবে বামেদের একটি আসনও জোটে নি, কংগ্রেসের ছিল নয়। সমীক্ষার ভাবনায় জোটের খান কুড়ি আসন বাড়ছে। এর রাশিবিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ হল কয়েকটি এলাকায় তাদের দিকে জনসমর্থন নির্বাচনে জেতার মত, অর্থাৎ সেই সব আসনে তারা প্রদত্ত ভোটের পঁয়ত্রিশ শতাংশ মত পেতে পারে। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে এই আসনের হিসেব কঠিন নয়, মুর্শিদাবাদ, মালদা, কিংবা উত্তর দিনাজপুরে (রায়গঞ্জ) তাদের কিছু আসন জেতা সম্ভব। তুলনায় বামপন্থীদের ভোট বাড়লেও তা আসন জয়ের অঙ্কে পৌঁছনো তুলনায় শক্ত। সেরকম যদি ঘটে তাহলে মূল মুশকিল কিন্তু বিজেপির। আবার হঠাৎ করে সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতারা যদি বাম-কংগ্রেসের প্রতি প্রীত হয়ে পড়েন, সেক্ষেত্রে তৃণমূলের ভোটে ভাগ পড়বে। উপসংহারে বলা যায় যে সামনের সমীক্ষাগুলোতে যদি বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট শতাংশ কমে, সেক্ষেত্রে সামনের দিনে তৃণমূল বা বিজেপির মধ্যে কে বেশি এগোচ্ছে সেটা বোঝা তুলনায় সহজ হবে। অন্যদিকে তৃতীয় পক্ষের ভোট যদি বারো শতাংশ থেকে বাড়ে এবং সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তাদের কোনওরকমের জোট হয়, সেক্ষেত্রে প্রধান দুই যুযুধান পক্ষের কে কতটা এগিয়ে আছে সেটা হয়ত সমীক্ষা থেকে চট করে বোঝা শক্ত। আপাতত অপেক্ষা তাই পরবর্তী সমীক্ষার ফলাফলের।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)