সুদীপ্ত আচার্য, কলকাতা: ভোটের মুখে ফের উত্তপ্ত ভাঙড়। পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের নির্মীয়মান ডিসট্রিবিউশন স্টেশন প্রকল্পের গেটে তালা বন্ধ করে আন্দোলন গ্রামবাসীদের। সরকারের তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি মতো বেশ কিছু দাবি না মেটানোর কারণেই এই আন্দোলন বলে দাবি গ্রামবাসীদের।


২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে রাজ্য রাজনীতির অন্যতম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ভাঙড়ের জমি আন্দোলন। পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার নির্মীয়মাণ পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হন এলাকার মানুষ। তাদের বক্তব্য ছিল পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন এর ওই প্রকল্পের ফলে দূষিত হবে এলাকার পরিবেশ, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এলাকার কৃষিজীবী মানুষের জীবিকা। পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পবিরোধী এই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতারের পর। পরের বছর ১৭ জানুয়ারি বিক্ষোভ চলাকালীন মফিজুল খান ও আলমগীর মোল্লা নামে দু'জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হলে রীতিমতো মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয় ভাঙড় ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা। পুলিশ না রাজনৈতিক দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন এই দুই গ্রামবাসীর তা নিয়ে চলতে থাকে চাপান-উতোর। ভাঙড়ের কাশীপুর, খামার আটি, শ্যামনগর-সহ বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। রাস্তায় আগুন জেলে, রাস্তা কেটে, পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে চলতে থাকে আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি, যার মুখপাত্র ছিলেন বাম নেতা অলীক চক্রবর্তী। আন্দোলনকারীদের পাশে এসে দাঁড়ান বাম এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রায় দেড় বছর চলে এই আন্দোলন। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও মেলেনি কোন সমাধান সূত্র। আন্দোলনকারীরা পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের কাজ বন্ধের দাবিতে ছিলেন অনড়। এরমধ্যে ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে খুন হন আরেক আন্দোলনকারী হাফিজুল মোল্লা। পঞ্চায়েত ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির সদস্যরা।



২০১৮ সালের ৩০ জুন ওড়িশা থেকে সিআইডি গ্রেফতার করে আন্দোলনের অন্যতম মুখ অলীক চক্রবর্তীকে। মাস দুয়েক পর জামিনও পান তিনি। এরপর সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সরাসরি আলোচনা শুরু হয়। বেশ কয়েক দফা আলোচনার পর, ১১ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাজ্য সরকার এবং পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তিতে বলা থাকে ভাঙ্গড়ের ওই জমিতে পাওয়ার গ্রিড তৈরি করা হবে না, একটি বিদ্যুৎ ডিসট্রিবিউশন সেন্টার তৈরি করা হবে। এর পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন দাবিও মেনে নেন সরকার। তার মধ্যে ছিল আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (UAPA) ধারা সহ বিভিন্ন ধারায় করা মামলা প্রত্যাহার, এলাকার আর্থিক এবং সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ইস্যু। কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ওই জমিতে ডিসট্রিবিউশন সেন্টার তৈরির কাজ।


তাহলে এখন  কীসের আন্দোলন?


প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন সকাল ন'টা থেকে ফের আন্দোলন শুরু হয়েছে ভাঙড়ের নির্মীয়মান বিদ্যুৎ প্রকল্পের গেটের সামনে। প্রথমে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে এই আন্দোলন শুরু হলেও, বেলা বাড়তেই আন্দোলন মোড় নেয় অন্যদিকে। আন্দোলনকারীরা প্রকল্পের গেটে তালা ঝুলিয়ে কাজ বন্ধ করে দেন। তাদের দাবি, স্থানীয় এলাকায় হিমঘর তৈরি, বিদ্যাধরী নদীর সংস্কার, কয়েকজন আন্দোলনকারীরা বিরুদ্ধে ইউপিএ মামলা প্রত্যাহার না করা,বকেয়া ক্ষতিপূরণ অবিলম্বে না মেটানোর জন্য তারা বাধ্য হয়েছেন আন্দোলন করতে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, ভাঙড় যেহেতু কৃষি প্রধান এলাকা, সেজন্য এখানে উৎপাদিত সবজি এবং মাছের সংরক্ষণের জন্য একটি হিমঘর স্থাপনের দাবি সরকার মেনে নিলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি এলাকার মৎস্যজীবী মানুষেরা বিদ্যাধরী নদীর দূষণের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এই নদী সংস্কার এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন। জমি আন্দোলনের অন্যতম নেতা অলীক চক্রবর্তী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী-সহ ৯ জন আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে মামলা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। তাদের বক্তব্য এর সমস্ত দাবি সরকার মেনে নিয়েছিল তাদের সঙ্গে হওয়া চুক্তির সময়। সে কারণেই সরকারের ঘুম ভাঙাতে তারা পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন এর নির্মাণ প্রকল্পের গেটে তালা ঝুলিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।


আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ভাঙড় (২) ব্লকের বিডিও নিজে আসেন আন্দোলনকারীদের বোঝানোর জন্য। প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে অবিলম্বে বকেয়া দাবিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদিও এই প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখতে পারেননি আন্দোলনকারীরা, সারারাত জেগে অবস্থান চালিয়ে গিয়েছেন তারা।


এই আন্দোলনের খবর পৌঁছে গিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের উচ্চ মহলে। আজ, বুধবার দুপুর একটার পর আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা শাসকের দফতরে আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে ছজনের প্রতিনিধি দলের মুখোমুখি হবেন রাজ্য প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা আছে রাজ্য মন্ত্রিসভার এক সদস্যেরও। ভাঙড়ের পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের এই প্রকল্প প্রধানত শুরু করা হয়েছিল রাজারহাট নিউটাউন এলাকার বিদ্যুৎ সমস্যা মোকাবিলার জন্য। ফলত এখনকার নির্মীয়মান বিদ্যুৎ ডিসট্রিবিউশন স্টেশনের কাজ বন্ধ হলে অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে পারিপার্শ্বিক এলাকার বিদ্যুৎ বণ্টনের বিষয়েও।আন্দোলনকারীদের বক্তব্য আজকের আলোচনা যদি ফলপ্রসূ না হয় তবে নির্মীয়মান প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখে লাগাতার আন্দোলন জারি রাখবেন তাঁরা।