নয়াদিল্লি: বুথফেরত সমীক্ষায় NDA জোটের জয়ের ইঙ্গিত মিলেছিল আগেই। কিন্তু সংখ্য়ার নিরিখে হারজিতের ব্যবধান যে এতটা হবে তা কল্পনা করতে পারেননি সমীক্ষকরাও। শুক্রবার বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই তাই চমকে ওঠেন সকলে। কারণ তেমন কোনও জনপ্রিয় মুখ ছাড়াই বিহারে একক বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। পাশাপাশি, নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল অপ্রত্যাশিত ভাবে ভাল করেছে। নির্বাচনের আগে যেখানে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর ‘কিংমেকার’ হতে পারেন বলে জোর জল্পনা ছিল। কিন্তু শেষমেশ চিরাগ পাসোয়ান এই নির্বাচনে NDA-র অন্যতম USP হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনের এহেন ফলাফলের জন্য SIR, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছেন বিরোধীরা। কিন্তু তেজস্বী যাদব এবং রাহুল গাঁধীর তরফেও খামতি রয়ে গিয়েছিল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। (Bihar Election Results)
নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত পরিসংখ্যান বলছে, বিহারের ২৪৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৮৯টিতেই জয়ী হয়েছে বিজেপি। নীতীশের JD-U জয়ী হয়েছে ৮৫টি আসনে। তেজস্বীর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (RJD) ২৫টি আসনে জয়ী হয়েছে। চিরাগের লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস) ১৯টি আসন ঝুলিতে পুরেছে। কংগ্রেস পেয়েছে ৬টি, AIMIM ৫টি, হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা (সেকুলার) ৫টি, রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা ৪টি, CPI (ML) ২টি ইন্ডিয়ান ইনক্লুসিভ পার্টি ১টি, CPM ১টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি পেয়েছে ১টি আসন। অথচ ২০২০ সালেও ৭৫টি আসন পেয়ে বিহারে একক বৃহত্তম দল ছিল RJD. এবারে একেবারে ২৫-এ নেমে গিয়েছে তারা। যদিও প্রাপ্ত ভোটের হারে এগিয়ে RJD. তারা ২৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। BJP পেয়েছে ২০.৮ শতাংশ ভোট। ১৯.২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে JD-U. ৮.৭১ ভোট পেয়েছে কংগ্রেস। (Bihar Election Results 2025)
বিহারে ২৪৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০২টিই NDA-র দখলে গিয়েছে। বিরোধীদের ‘মহাজোট’কে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছে তারা। ফলে দশমবারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন নীতীশ। কিন্তু নির্বাচন পূর্ববর্তী সমস্ত সমীক্ষাতেই নীতীশকে নিয়ে সংশয় ছিল। এযাবৎ একার ক্ষমতায় বিহারে সরকার গড়তে না পারা BJP যে একক বৃহত্তম দল হয়ে উঠবে, তা ভাবনাতেও ছিল না কার্যত। আবার এত আশা জাগিয়েও প্রশান্তর জন সুরাজ পার্টি যে খাতাও খুলতে পারবে না, তা নিজেও ভাবতে পারেননি একদা ভোটকুশলী। বিহারের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে সমস্ত হিসেবনিকেশ এভাবে ওলটপালট হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে, যেমন, নির্বাচনের ঠিক আগে ১.৩ কোটি মহিলার জন্য ১০০০০ টাকা বরাদ্দ করে নীতীশ ও বিজেপি-র জোট সরকার। ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’র আওতায় মহিলাদের স্বনির্ভর করে তুলতে অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা করে জমা পড়ে। গোড়াতেই সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলে কংগ্রেস ও RJD. ভোট চলাকালীন ১০ হাজার টাকা করে অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া কি নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন নয়,প্রশ্ন তোলে তারা। নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ তোলে।
মহিলাদের ভোটও নীতীশের পক্ষে গিয়েছে বলে একাধিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। কিছু বছর আগেই বিহারে মদ নিষিদ্ধ করেন নীতীশ। নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন তেজস্বী এবং প্রশান্ত মদের উপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এতে মহিলারা অসন্তুষ্ট হন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও খাতায়কলমে নিষিদ্ধ হলেও, ভিন্ন উপায়ে, ভিন্ন নামে বিহারে দেদার মদবিক্রি চলছে বলে একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে। পাশাপাশি, লালুপ্রসাদ যাদবের আমলে বিহারে ‘জঙ্গলরাজ’, ‘কাট্টারাজ’ চলত বলে ভাষ্য তৈরিতে সফল হয় বিজেপি এবং NDA, যা বিরাট ক্ষতি করে RJD-র। রোজগার, উন্নয়নের সপক্ষে জোর প্রচার চালানো সত্ত্বেও তাই ধাক্কা খেতে হয়েছে তেজস্বীকে। পাশাপাশি, RJD-র থেকে এবার ‘যাদব ভোট’ও সরে যেতে দেখা গিয়েছে নীতীশের দিকে। ৬১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে কংগ্রেস যে মাত্র ৬টি আসনে জিতেছে, তাতেও ক্ষতি হয়েছে বিরোধীদের ‘মহাজোটে’র।
ভোটমুখী বিহার দিয়েই গোটা দেশে SIR শুরু হয়েছে। বিহারে প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়াকে ঘিরে তেতে উঠেছিল জাতীয় রাজনীতি। সেই থেকে দফায় দফায় সাংবাদিক বৈঠক করে বিজেপি ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘ভোটচুরি’র অভিযোগ তুলেছেন রাহুল, অসঙ্গতির খতিয়ানও তুলে ধরেছেন বার বার। কিন্তু বিহারের আমজনতার কাছে সেই বার্তা গিয়েছে বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাহুলের ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানের কোনও প্রভাব যেমন বিজেপি-র ভোটবাক্সে পড়েনি, বিহারেও ‘ভোটচুরি’র কোনও প্রভাব দেখা যায়নি। বরং জনমোহিনী প্রকল্প নজর কেড়েছে সাধারণ মানুষের।
বিহারে বিরোধীদের এমন ফলাফল নিয়ে মুখ খুলেছেন প্রাক্তন আমলা তথা একদা সাংসদ জহর সরকারও। তিনি যে কার্যকারণগুলি চিহ্নিত করেছেন, সেগুলি হল- ‘১) নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব, SIR-এর মাধ্যমে ভোটার তালিকায় কারচুপি, NDA-বিরোধী ভোটারদের নাম মুছে দেওয়া, ২) প্রকাশ্যে ঘুষদান, ৭৫ লক্ষ মহিলার অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা জমা করা, ৩) প্রকাশ্যে ভোটারদের হাতে নগদ থেকে উপহার তুলে দেওয়া, ৪) মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তেজস্বী আদর্শ নন, ৫) লালু-জমানাকে গুন্ডা-রাজ হিসেবেই দেখে বিহার’।
এই নির্বাচন গোড়া থেকেই যে একপেশে ছিল, তা প্রকাশ্যেই লিখেছেন রাহুল। সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি। বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা ভূপেশ বাঘেলও একই কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, “৬৫ লক্ষ ভোটারের না মুছেছেন। জ্ঞানেশ কুমারকে অভিনন্দন।” বিহারে জাতপাত ও খয়রাতির রাজনীতিই যে বৈধতা পেল, রোজগার-শিক্ষার কথা বলেও যে খালিহাতে ফিরতে হল, তা মেনে নিয়েছে প্রশান্তর জন সুরাজ পার্টিরও। বাকিরা বিদ্রুপ করলেও প্রশান্তকে ‘অভিমন্যু’ বলে অভিহিত করেছে তাঁর দল। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন আবার লেখেন, 'বিহারের নির্বাচন থেকে সকলকে শিক্ষা নিতে হবে। I.N.D.I.A শিবিরের নেতারা অভিজ্ঞ, বার্তা বোঝার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে তাঁদের, সেই মতো পরিকল্পনামাফিক কঠিন পরিস্থিতি পেরনোর ক্ষমতাও আছে। কিন্তু এই ফলাফল দিয়ে নির্বাচন কমিশনের অপকর্ম এবং বেপরোয়া পদক্ষেপ ভুলে যাওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি সবচেয়ে তলানিতে এখন। দেশের নাগরিকদের মজবুত ও নিরপেক্ষ কমিশন প্রাপ্য, যাতে জিততে না পারলেও সকলের আস্থা বজায় থাকে।'
কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপি-র কৌশলকে এগিয়ে রেখেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের মতে, অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা প্রচার করতে গেলেও, বিহারে সেই অর্থে জনপ্রিয় কোনও মুখই নেই পদ্মশিবিরের। কিন্তু তাদের হয়ে আসল কাজটি করে দেখিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে বিহারের ভোটের বৈতরণী সামলানোর দায়িত্ব পান তিনি। শুধু জমি প্রস্তুত করাই নয়, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের তুষ্ট করার দায়িত্বও পালন করেন সাফল্যের সঙ্গেই। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ থেকে উঠে আসা ধর্মেন্দ্রকে নিয়ে তাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। একজন বলেন, “হাতে সময় কম ছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অনেক কিছু। দলের কৌশল বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওঁকে। বিশেষ করে বিদ্রোহীদের মানভঞ্জনের ভার ছিল ওঁর কাঁধে। টিকিট বিলির দায়িত্বও দেওয়া হয়। পাশাপাশি উনি OBC শ্রেণির প্রতিনিধি। ফলে জাতপাতের অঙ্কেও দলের সুবিধা হয়েছে।” ভোটমুখী বিহারে খবর করতে যাওয়া এক সাংবাদিক তাই জানান, অক্টোবর মাসে বিজেপি-র সাসংদ সতীশ গৌতমের সঙ্গে দেখা হয় বক্সারে। তখনই সেখানে একমাস ধরে কাজ পড়েছিলেন তিনি। পটনায় বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে দলের পুস্তিকা বিলি করতে দেখেন উত্তরপ্রদেশে বিজেপি-র প্রাক্তন সভাপতি, তথা যোগী আদিত্যনাথ সরকারের মন্ত্রী স্বতন্ত্র দেব সিংহকে। রাহুল মৎস্যজীবীদের সঙ্গে পুকুরে সাঁতার কাটলেও, তেজস্বী মানুষের ভিড়ে শামিল হলেও, তাঁদের দলের অন্য হাই-প্রোফাইল নেতারা মাটির কাছে কতটা আছেন, সেই প্রশ্ন উঠে এসেছে অবধারিত ভাবেই।