পার্থপ্রতিম ঘোষ ও সৌমেন চক্রবর্তী, বালেশ্বর: মুহূর্তের সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল সেই রাতে। একসঙ্গে তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছিল বাহানাগা বাজারের কাছে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে শুরু হয়েছিল উদ্ধারকাজ। অত দেহ কোথায় রাখা হবে? ওই ঘটনার দিন রাতে কাছেই বাহানাগা হাইস্কুলে রাখা হচ্ছিল দেহ। ট্রাকে করে স্কুলে মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে রাখা হচ্ছিল। স্কুলে দেহ রাখার খবর শুনে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছিলেন বাহানগা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। এসেই চমকে ওঠেন তিনি। কারণ স্কুলের প্রেয়ার রুমে তখন স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। কিন্তু তারপরে যা দেখলেন তাতে কার্যত তাঁর পায়ের তলার মাটিই সরে গিয়েছিল। কারণ মৃতদেহের সেই স্তূপে একটি মুখ দেখেই চমকে উঠেছিলেন তিনি। সেই দেহটি ছিল তাঁর ভাইয়ের। সেদিনের সেই 'অভিশপ্ত' করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ছিলেন তাঁর ভাইও।


২-রা জুন। গত শুক্রবার ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সন্ধে সওয়া ৭টা। দুর্ঘটনার পরে দেহ উদ্ধার শুরু হয়েছে। আর বালেশ্বরের বাহানাগা হাইস্কুলে এসে পৌঁছচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ ভর্তি ট্রাক।  স্কুলের প্রার্থনা হলের মেঝেতে নামিয়ে রাখা হচ্ছে একের পর এক ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত নিথর দেহ। এই দৃশ্য় দেখে ভয়ে-আতঙ্কে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে ফোন করেন কেয়ারটেকার। গোটা ঘটনা জানান। সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে ছুটে আসেন প্রধান শিক্ষিকা। কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি কী ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাঁকে। মেঝেতে শোয়ানো মৃতদেহের সারির মধ্যে ছিল তাঁর অতি চেনা একটি মুখ। নিজের ভাইয়ের মুখ। 


তাঁর নিজের কাকার ছেলে। নাম রাজেন্দ্র বল, বয়স বছর ৩৬। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্য়াঙ্কের ভদ্রকের শাখার কর্মরত ছিলেন। ওড়িশার জেলা স্তরের ক্রিকেটারও ছিলেন রাজেন্দ্র। মাত্র কয়েক মাস আগেই বিয়ে হয়েছিল তাঁর। শুক্রবার, বালেশ্বর স্টেশন থেকে উঠেছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। ভদ্রকে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ভদ্রক যাওয়া আর হয়নি তাঁর। পরের স্টেশন বাহানাগাতেই থমকে যায় তাঁর যাত্রা। নিজের ভাইকে এভাবে দেখতে হবে, ভাবতেও পারেননি এই প্রধানশিক্ষিকা। পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন বাহানাগা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা প্রমীলা সাঁই।


বর্তমানে বাহানাগা হাইস্কুল থেকে সমস্ত মৃতদেহ ভুবনেশ্বর AIIMS-এ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওড়িশায় এখন গরমের ছুটি চলছে। ১৯ জুন স্কুল খুলবে। সেই সময়ে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বাধ্য হয়েই স্কুলের ভিতরে দেহ রাখতে হয়েছিল। গরমের ছুটি শেষ হওয়ার আগে মাত্র দেড় সপ্তাহ রয়েছে। তার আগে জোরকদমে চলছে স্কুল পরিষ্কারের কাজ। দাঁড়িয়ে থেকে স্কুল স্য়ানিটাইজ করাচ্ছেন বিডিও। স্কুলকে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু, ঘটনার বীভৎসতা ভুলতে পারছেন না প্রধান শিক্ষিকাই!এই স্কুলে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠন হয়। পড়ুয়া সংখ্য়া ৫৬৫। 


বেঁচে ফেরা:
কথায় বলে, রাখে হরি মারে কে!বাস্তবে তারই প্রমাণ মিলল বালেশ্বরে। উদ্ধারকারীরা ভেবেছিলেন, তিনি মারা গিয়েছেন। তাই তাঁর স্থান হয়েছিল মৃতদেহের স্তূপে। করমণ্ডলে রেল বিপর্যয়ে মৃতদেহের স্তূপে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হল এক ব্যক্তিকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা রবীন নাইয়া আরও ১০ জনের সঙ্গে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে অন্ধ্রপ্রদেশে যাচ্ছিলেন ধান রোয়ার কাজ করতে। পরিবারের দাবি, দুর্ঘটনার সময় প্রাণে বাঁচতে ট্রেন থেকে ঝাঁপ মেরেছিলেন রবীন। অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উদ্ধারকাজ শুরুর পর মৃত ভেবে তাঁকেও মৃতদেহের সারিতে শুইয়ে রাখা হয়। জ্ঞান ফেরার পর সবাই বুঝতে পারেন তিনি তখনও জীবিত। রবীন ফিরলেও এখনও নিখোঁজ তাঁর ৪ সঙ্গী। মৃত্যু হয়েছে তাঁর অন্য ৫ সঙ্গীরও।


আরও পড়ুন: পাটনায় বিজেপি বিরোধী মঞ্চে পাশাপাশি রাহুল-মমতা? থাকবেন কেজরিও? বাড়ছে জল্পনা