নয়াদিল্লি: ভোটগ্রহণের ফুটেজ সংরক্ষণ নিয়ে নীতি বদল করল ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। বলা হয়েছে, ফলাফল ঘোষণার পর ৪৫ দিন পর্যন্ত ভোটপ্রক্রিয়ার (ভোটগ্রহণ, গণনা-সহ বিভিন্ন ধাপ)  ছবি ও ভিডিও ফুটেজ মজুত রাখা হবে। ওই সময়ের মধ্যে কোনও মামলা না হলে, সবকিছু নষ্ট করে দেওয়া হবে। ভোটগ্রহণের সময়কার বুথের ছবি ও ভিডিও ফুটেজের ‘অপব্যবহার’ রুখতেই এমন পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। (Election Commission)

গত ৩০ মে সমস্ত নির্বাচনী আধিকারিকদের এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়। জানানো হয়, সাম্প্রতিক কালে ভোটপ্রক্রিয়ার ছবি ও ভিডিও-র অপব্যবহার শুরু হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পর ভোটগ্রহণের ছবি ও ফুটেজ নষ্ট করে দিতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে ভোটপ্রক্রিয়ার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ চেয়ে মামলা হলে যদিও আলাদা কথা বলে জানানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য নির্দিষ্ট বুথের ফুটেজ রেখে দেওয়া হবে। (Election Footage)

নির্বাচন কমিশন যুক্তি দিয়েছে যে, ভোটগ্রহণের ফুটেজ মজুত রাখা নিয়ে তেমন কোনও আইন নেই। বরং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার অংশ গোটা প্রক্রিয়া। সম্প্রতি যেভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে, সোশ্য়াল মিডিয়ায় অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে, ভুল ভাষ্য তৈরি করা হচ্ছে, অযথা যে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, তাতেই বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা হয় এবং সেই মতো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এর আগে, ২০২৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন যে নির্দেশিকা জারি করেছিল, তার আওতায় ছ’মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত ভোটপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়। মনোনয়ন পর্বের আগের ফুটেজ তিন মাস মজুত রাখা নিয়ম ছিল। মনোনয়ন, প্রচার, বুথে বুথে ভোগ্রহণ এবং গণনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ছ’মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণই নিয়ম ছিল এতদিন। কিন্তু নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ফলাফল প্রকাশের পর ৪৫ দিন পর্যন্তই ফুটেজ মজুত থাকবে। ওই সময়ের মধ্যে কোনও মামলা হলে, সংশ্লিষ্ট বুথের বা গণনাকেন্দ্রের ফুটেজ রেখে দেওয়া হবে। ৪৫ দিন পরে হলে আর পাওয়া যাবে না।

নির্বাচন করানোর ক্ষেত্রে EVM মেশিন পরীক্ষা করে দেখা থেকে, সেগুলি স্থানান্তরিত করা, ভোটগ্রহণ, ভোটগণনা, সবকিছুরই ভিডিওগ্রাফি হয়। তোলা হয় ছবিও। বুথের ভিতর লাইভ ওয়েবকাস্টিংয়ের ব্যবস্থা থাকে, অর্থাৎ কোন বুথে কী চলছে, তা সরাসরি দেখা যায় কন্ট্রোল রুম থেকে।  প্রচারে কোন প্রার্থী কত খরচ করছেন, আদর্শ আচরণ বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, তার জন্যও ভিডিওগ্রাফি চলে। সেই ফুটেজ সংরক্ষণ নিয়েই নয়া সিদ্ধান্তে উপনীত হল কমিশন। এর আগে, গত বছর ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনী বিধির ৯৩(২) (এ) ধারাও সংশোধন করে কমিশন। আগে নির্বাচন কমিশনের ফুটেজ চাইলে যে কেউ দেখতে পেতেন। এখন আর সাধারণ মানুষ ফুটেজ দেখতে পাবেন না। আগে যেহেতু ব্যালটে ভোট হতো, তাই কাগজ দেখার অধিকার সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু পুরনো আইন সংশোধন করে কমিশন জানায়, কাগজ আর ভিডিও এক নয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পুরনো আইনে ওই সংশোধন ঘটায় কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক। হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে ফুটেজ প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিল পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট। আদালতের ওই নির্দেশের দুই সপ্তাহের মধ্যে পুরনো আইন পাল্টে দেওয়া হয়। সেই সময়ও তীব্র প্রতিবাদ শোনা গিয়েছিল। কারণ ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে চণ্ডীগড় পুরসভা নির্বাচনে খোদ প্রিসাইডিং অফিসারকে নির্বাচনে কারচুপি করতে দেখা যায়। বিজেপি-কে জিতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নিয়ে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয় সুপ্রিম কোর্টকে।  এবারও ৪৫ দিনের মধ্যে ফুটেজ নষ্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। 

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রতি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ নিয়ে বার বার সওয়াল করেছেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গাঁধী। নির্বাচন কমিশনের নয়া সিদ্ধান্ত নিয়েও মুখ খুলেছেন তিনি। রাহুল সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘ভোটার তালিকা? Machine-Readable ফর্ম্যাট দেবে না। CCTV ফুটেজ? আইন পাল্টে আড়া করে দেবে। নির্বাচনের ছবি ও ভিডিও? এক বছর নয়, ৪৫ দিনেই সব মুছে দেবে। যার কাছে জবাব চাওয়া হচ্ছে, সে নিজেই প্রমাণ নষ্ট করে দিচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ম্যাচ ফিক্সিং হচ্ছে। গণতন্ত্রে এই ধরনের ম্যাচ ফিক্সিং বিষের সমান’।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে লাগাতার সওয়াল করে আসছেন রাহুল। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনও লেখেন তিনি, যেখানে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলেন তিনি। ওই প্রতিবেদনে একাধিক বিষয় তুলে ধরেন রাহুল। তাঁর বক্তব্য ছিল, 'গণতন্ত্রে ছাপ্পাভোটের অন্যতম নিদর্শন মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচন ২০২৪। ঠিক কী ঘটে, ধাপে ধাপে বুঝত হবে, ১) নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্যানেলই ঘেঁটে দেওয়া, ২) ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটারের নাম যুক্ত করা, ৩) ভোটারের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো, ৪) যেখানে বিজেপি-কে জিততে হবে, সেখানে ভুয়ো ভোটকে নিশানা, ৫) প্রমাণ লোপাট'। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক আজকের নয়। এতদিন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন এনে প্রধআন বিচারপতিকে প্যানেল থেকে সরিয়ে দিয়ে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে যুক্ত করেছে। ফলে কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়াও ত্রুটিপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।