ঘোড়ামারা: সর্বস্ব ভেসে গিয়েছে। ধ্বংসস্তুপের ওপর বসে স্মৃতিচারণ ছাড়া আর উপায় নেই। কারোও ঠাঁই খোলা আকাশের নীচে। কেউ জলে ডোবা সংসারে তন্নতন্ন করে খুঁজেই চলেছে শেষ সম্বল। অল্প রোদের মুখ দেখতেই কেউ ব্যস্ত ধান শুকোনোয়। যতটুকু বাঁচানো যায় আর কি। সাগরের বাসিন্দা সুনীতা দাস বলছেন, তিন চারদিন ভাতের মুখ দেখিনি।
চলে গিয়েছে ইয়াস। রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। যে ক্ষত কবে সারবে তা জানে না, এই মানুষগুলো। ৬ দিন পরও এখনও, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর ব্লকের ঘোড়ামারা দ্বীপের বহু এলাকা জলমগ্ন। বঙ্গোপসাগর আর মুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ঘেরা এই ঘোড়ামারা দ্বীপ। ঢেউয়ের মাথায় বাস করা এই মানুষগুলোর জীবন এক নিমেষে টলিয়ে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।
কিছু কিছু জায়গায় জল নামলেও এখনও জলমগ্ন বহু এলাকা। নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কাঁচাবাড়ি। যেগুলো টিকে গেছে, তাও জলে থইথই। উচুঁ রাস্তার পাশে ত্রিপল টাঙিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন কেউ। কারও আবার সেটুকুও জোটেনি। ডুবে গেছে চাষের জমি। পানীয় জল থেকে খাবারের সঙ্কট। এ দ্বীপের সবটাই এখন গ্রাস করেছে একরাশ হাহাকার।
সমস্যা এতটাই, যে অনেকেই চলে যাচ্ছেন এ দ্বীপ ছেড়ে। বাসিন্দারা বলছেন, আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই, কোথায় যাব, যাদের জায়গা আছে, চলে যাচ্ছে, গরু, ছাগল মরে গেছে, জমা জলে দুর্গন্ধ।
সব শেষ হয়ে গিয়েছে, কেউ সাহায্য না করলে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নেই বলেই জানাচ্ছেন ওঁরা। কবে ফের আগের মতো ছন্দে ফিরবে জীবন? অপেক্ষায় গুমরে কাঁদছে ঘোড়ামারা।
বঙ্গোপসাগর আর মুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ঘেরা ঘোড়ামারা দ্বীপ। ৫ বছর আগের প্রশাসনিক তথ্য অনুযায়ী, ১৩০ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপ মাত্র ২৫ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। যার মধ্যে ১৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা উপকূলীয় অঞ্চলে। প্রকৃতির রুদ্ররোষ কত নির্মম হতে পারে, তা মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করছে ঘোড়ামারার দুটি পরিবার।
বাচ্চু জানা আর রুল আমিন গায়েন। দুই পরিবারই সাগর ব্লকের ঘোড়ামার দ্বীপের বাসিন্দা।
ঢেউয়ের মাথায় বাস করা মানুষগুলির মধ্যে একটি পরিবার হল জানা পরিবার। গৃহকর্তা ছিলেন ৭৫ বছরের বৃন্দাবন জানা। পরিবার সূত্রে খবর, ২৬ মে ইয়াস আছড়ে পড়ার দিন সকালে, ঢেউ দেখে সবাইকে সতর্ক করতে বেরোন তিনি। শেষ পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যান নিজেই। পরে ভেসে ওঠে তাঁর মৃতদেহ।
একদিকে, বাবাকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ ছেলে, অন্যদিকে, নিখোঁজ ছেলের পথ চেয়ে এক বাবা।২৬ মে-র ভরা কটালে গ্রামে জল ঢুকতে দেখে ঘর ছাড়তে শুরু করে রুল আমিন গায়েনের পরিবার। পরিবার সূত্রে খবর, সেই সময়, জলের খরস্রোতে বাবার হাত ফসকে তলিয়ে যায় তাঁর দেড় বছরের সন্তান। এখনও সে নিখোঁজ। তল্লাশি চলছে। নিখোঁজ শিশুর বাবা রুল আমিন গায়েন বলেছেন, 'যখন প্রচুর জল চলে আসে, ঘর থেকে বেরোচ্ছিলাম, বড় ছেলেও ছিল। ছোট ছেলে জলের তোড়ে হাত ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এখনও খুঁজে পাচ্ছি না।'