কলকাতা: লাল কেল্লা থেকে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স পুনর্বিবেচনা করছেন তাঁরা। এ জন্য দেশজুড়ে সমীক্ষা চলছে, গঠন করা হয়েছে কমিটি। তাদের সুপারিশ বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র।


মূলত মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার কমাতে এ ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করছে কেন্দ্র। এর আগে ২০১৮ সালে আইন কমিশন বলে, নারী পুরুষ, ধর্ম নির্বিশেষে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ হওয়া উচিত। আর এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখেও শোনা গেল মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স পুনর্বিবেচনার কথা। অবশ্য বিয়ের বয়স ৩ বছর বাড়ালেই গার্হস্থ্য হিংসা কমে যাবে কিনা বা অপুষ্টির হার কমবে কিনা তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দিহান। তাঁদের মতে, এর ফলে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলির ওপর চাপ বাড়বে, বাড়তে পারে নারী পাচার।

আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় যেমন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দেশের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ আর্থিকভাবে পিছিয়ে, মূলত আর্থিক কারণেই তাঁরা মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেন। পশ্চিমবঙ্গেও নাবালিকা বিবাহের একাধিক ঘটনা আমরা দেখেছি, অনেক সময় প্রশাসনকে গিয়ে সেই বিয়ে থামাতে হয়েছে, আবার অনেক সময় খবরই আসেনি। মেয়ে তাদের কাছে এখনও বোঝা। যদি কোনও পরিবারকে ১৮-র পর আরও ৩ বছর মেয়ের দায়িত্ব নিতে হয়, তবে তার প্রতি নির্যাতন হতে পারে বা নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে পারে। তাঁর মতে, এর ফলে পালিয়ে গিয়ে, লুকিয়ে বিয়ে করা বা বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে, বাড়বে নারী পাচার। জাল বার্থ সার্টিফিকেট বার করে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বাড়বে। পরিবার থেকেই হয়তো পাচার করে দেওয়া হবে মেয়েকে। বিশেষ করে হরিয়ানা, রাজস্থানের মত রাজ্যে বেড়ে যেতে পারে কন্যা ভ্রূণ হত্যা। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটি মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া উচিত, এ দেশের আর্থিক পরিকাঠামো বিয়ের বয়স এক লাফে ৩ বছর বাড়িয়ে দেওয়া সমর্থন করে না বলে মনে করছেন তিনি।

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার তুলে ধরছেন গার্হস্থ্য হিংসার কথা। তিনি মনে করেন, শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হওয়া মেয়েরা আর একটু বেশি বয়সে বিয়ে হলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামলাতে পারবে। ২১ বছরে বিয়ে মানে তার শিক্ষার হার বেশি হওয়ার কথা, হয়তো আর্থিকভাবেও কিছুটা সঙ্গতি থাকবে। এখন ১৬, ১৭ বছর বয়সের মেয়েকেও ১৮ বলে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিয়ের বয়স বেশি হলে কিছুটা সামাজিক, আর্থিক জোর বাড়বে তার। নিজের অধিকার সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মাবে, কী তার পাওয়ার কথা, আর কী পাচ্ছে। তবে তিনি মনে করেন, এ জন্য মেয়েদের সামগ্রিকভাবে স্বনির্ভর করা, শিক্ষিত করা জরুরি। সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না করে শুধু বিয়ের বয়স বাড়িয়ে দিলে তারা যে তিমিরে রয়েছে, সেই তিমিরেই রয়ে যাবে।  তাঁর মতে, মেয়েদের আইনি অধিকারের কথা তাদের জানানো প্রয়োজন। নির্যাতিতা জানেই না, তার ওপর যে অত্যাচার চলছে, আইনে তার প্রতিকারের রাস্তা আছে। তাই নারীপুরুষ নির্বিশেষে বিবাহ সম্পর্কিত চুক্তিতে নিজের অধিকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা জরুরি।

স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ সুষুপ্তা চৌধুরী আবার মেয়েদের বিয়ের বয়স বৃদ্ধির চিন্তা স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গ্রামের দিকে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। ফলে টিন এজ প্রেগনেন্সির হার বেশি, তখনও একটি মেয়ের শরীর পূর্ণতা পায় না। আর অল্প বয়সে গর্ভবতী হলে মা ও শিশু দুজনেরই শারীরিক জটিলতা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া মানসিকভাবেও সে তখন একটি শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার মত যথেষ্ট পরিণত নয়। হাইপারটেনশন, প্রেগনেন্সি রিলেটেড ডিপ্রেশন ও পোস্ট নেটাল ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে সে। উল্টে ২১-এ যদি তার বিয়ে হয়, ২২ বা ২৩ বছরে মা হয়, তবে তার শারীরিক বৃদ্ধি ততদিনে সম্পূর্ণ, তার সন্তান জন্মের জটিলতা কম হবে, সুস্থ থাকবে শিশুও। চিকিৎসক সুকান্ত মুখোপাধ্যায় মনে করেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর থেকে বেশি জরুরি, তারা যাতে পুষ্টিকর খাবার পায়, সে দিকে নজর দেওয়া। অপুষ্ট শরীরে মা হতে গিয়ে অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে, আবার মারাও যাচ্ছে। তাই এই বিষয়গুলি আগে বিবেচনা করে তারপর সরকারের বিয়ের বয়স বৃদ্ধির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।