নয়নিমা বসু, নয়াদিল্লি: খালিস্তানি সমব্যথী হরদীপ সিংহ নিজ্জরের মৃত্যুতে ভারতের দিকে আঙুল তুলেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। শিখ নেতার মৃত্যুতে দিল্লির সংযোগ খতিয়ে দেখছে সে দেশের তদন্তকারীরা (Khalistani Separatists)। সেই আবহেই ট্রুডোর অভিযোগ খারিজ করে দিল ভারত। কানাডার অভিযোগ অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করল বিদেশমন্ত্রক। খালিস্তানি জঙ্গি এবং উগ্রপন্থী, যাঁরা কানাডার আশ্রয়ে রয়েছেন, তাঁদের থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে বলেও কানাডার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলল ভারত। (India Canada Relations)


গত ১৮ জুন সারি-তে শিখদের একটি মন্দিরের বাইরে গুলি করে খুন করা হয় হরদীপকে। কানাডায় শিখ নেতা হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। সেই ঘটনায় ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (RAW)-এর প্রধান, ১৯৯৭ ব্যাচের আইপিএস অফিসার, দেশের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক পবনকুমার রাইকে সোমবার বহিষ্কার করেছে কানাডা সরকার। 


এ নিয়ে কড়া বিবৃতি জারি করেছেন ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি। তিনি বলেন, "দেশের পার্লামেন্টে কানাডার প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের বিদেশমন্ত্রী যে দাবি করেছেন, তা খারিজ করছি আমরা। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের হিংসায় যুক্ত থাকার অভিযোগ অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"


দিল্লিতে আয়োজিত সাম্প্রতিক জি-২০ সম্মেলনেও বিষয়টি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং জাস্টিন ট্রুডোর মধ্যে আলোচনা হয় বলে জানিয়েছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক। বাগচি বলেন, "কানাডায় আশ্রিত খালিস্তানি জঙ্গি এবং উগ্রপন্থী, যাঁরা ভারতের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমিকতা নষ্ট করার হুমকি দিয়ে চলেছে লাগাতার, তাঁদের থেকে নজর ঘোরাতেই এই ধরনের সারবত্তাহীন অভিযোগ সামনে আনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কানাডার সরকারের নিষ্ক্রিয়তা বহু দীর্ঘ দিন ধরেই উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে।"


আরও পড়ুন: New Parliament: জমকালো উপস্থিতি, তাক লাগানো সাজসজ্জা, নয়া সংসদভবন পেল দেশ


বাগচি জানান, এযাবৎ কানাডার রাজনৈতিকরা খালিস্তানপন্থীদের প্রতি সমবেদনাই জানিয়ে এসেছেন। খুন, মানবপাচার, সংগঠিত অপরাধ-সহ  বেআইনি কার্যকলাপের যে অবাধ ছুট রয়েছে কানাডায়, তা নতুন নয় একেবারেই। কিন্তু তার সঙ্গে ভারত সরকারের নাম জড়ানোর চেষ্টার প্রতিবাদ করছে দিল্লি। বাগচি বলেন, "কানাডার সরকারকে আমাদের অনুরোধ, তাদের দেশের মাটি থেকে ভারতবিরোধী সব সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হোক।" 


দেশের পার্লামেন্টের হাউজ অফ কমন্সে গোয়েন্দা রিপোর্ট তুলে ধরে নিজ্জরের মৃত্যুর সঙ্গে ভারতের সংযোগ রয়েছে বলে দাবি করেন ট্রুডো। কনজারভেটিভ নেতা পিয়ের পয়লেভরে, ব্লক কোয়েবেকোয়সে হাউজ লিডার অ্যালেন থেরিয়েন এবং NDP নেতা জগমিত সিংহও একই অভিযোগ করেন। ট্রুডো বলেন, "গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কানাডার নিরাপত্তা সংস্থাগুলি দেশের নাগরিক হরদীপ সিংহ নিজ্জরের মৃত্যুর সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য সংযোগ খতিয়ে দেখছিল। কানায় আইনের শাসন রয়েছে। দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমিকতা রক্ষা করা আমাদের মৌলিক নীতি। দেশের সমস্ত নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দেশের আইন এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলির কাছে প্রাধান্য পায়, এবং এই খুনের ঘটনায় প্রয়োজনী পদক্ষেপ করা আমাদের দায়িত্ব।"


ভারত সরকার এবং ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার ভূমিকা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলেও মন্তব্য করেন ট্রুডো। তিনি বলেন, "গত সপ্তাহে জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিষয়টি উত্থাপন করি আমি। কানাডার মাটিতে, কানাডীয় নাগরিকের মৃত্যুর নেপথ্যে অন্য দেশের যোগসূত্র পাওয়া গেলে, তাতে আমাদের দেশের সার্বভৌমিকতা লঙ্ঘিত হয়, যা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ধরনের ঘটনা স্বাধীন, মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক সমাজব্য়বস্থারও পরিপন্থী।"


ট্রুডো আরও বলেন, "প্রত্যাশিত ভাবেই, বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি আমরা। সহযোগীদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা চলছে। সত্য উদঘাটনে ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। অন্য দেশের মাটিতে এই ধরনের কার্যকলাপ ঘটানোর ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান জানতে চাই, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী।"


আরও পড়ুন: Cabinet Meeting Today:৩৩% মহিলা সংরক্ষণ বিলে অনুমোদন দিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, খবর সূত্রে


সেখানেই থামেননি ট্রুডো। সুর চড়িয়ে বলেন, "বহু কানাডীয়, বিশেষ করে ইন্দো-কানাডীয়রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এই মুহূর্তে একরকম ভাবে আতঙ্কেও রয়েছেন। কিন্তু এই রাগ আমাদের কাবু করে ফেলে, এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে লক্ষ্য নিবিষ্ট থাকতে হবে, গণতান্ত্রিক নীতি এবং আইনের শাসন টিকিয়ে রাখার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে আমাদের। স্থিরচিত্ত এবং শান্তিকামী অবস্থানই আমাদের পরিচয়।"


কানাডার বিদেশমন্ত্রী জলি জানিয়েছেন, এই ঘটনায় ভারত সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা চাইছেন তাঁরা। পলিয়েভরে জানিয়েছেন, সত্যিই সত্যিই যদি এই ঘটনায় ভারতসংযোগ ধরা পড়ে, কানাডার সার্বভৌমিকতার জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ। বলেন, "বিচার বহির্ভূত খুন থেকে আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে, বিশেষ করে বিদেশি সরকারের হাত থেকে। কানাডার মাটিতে, কানাডীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রাপ্য।" NDP নেতা জগমিতের কথায়, "সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের বিভাজনমূলক রাজনীতি, হিংসা, খুন এবং হামলার নীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আমরা। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে কড়া বার্তা দেওয়ার সময় এসেছে। " ভারতীয় কূটনীতিকে বহিষ্কারের ঘটনাও দুই দেশের মধ্যে সংঘাত বাড়িয়ে তুলেছে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘটনা। 


কানাডার জনপ্রিয় শিখ নেতা, বছর ৪৫-এর হরদীপ কানাডায় সাফাইকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সারি-তে শিখ মন্দিরের প্রধানও ছিলেন তিনি। খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ভারতে তাঁর নাম রয়েছে পুলিশের খাতায়। শিখস ফর জাস্টিস (SFJ) নামের একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাকামী নেতা গুরুপতওয়ন্ত সিংহ পান্নুমেরও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন হরদীপ। ব্রিটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় কূটনীতিকদের খুনের হুমকি দেওয়াতেও নাম জড়িয়েছে তাঁর।


শুধু তাই নয়, ভারতের পঞ্জাব ভেঙে পৃথক খালিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন মিছিলেও  নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় হরদীপকে। ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয়কুমার বর্মা এবং কনসাল জেনারেল অপূর্ব শ্রীবাস্তবের বিরুদ্ধে টরন্টোয় মিছিল বের করে, হুমকিও দেন। ওট্টাওয়া, টরন্টো এবং ভ্যাঙ্কুভারে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছেন যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে এ বছর জুলাই মাসে কানাডা সরকারের কাছে আবেদনও জানায় ভারত সরকার। সাউথ ব্লকে ডেকে পাঠানো হয় কানাডার হাই কমিশনার ক্যামেন ম্যাকে-কে।