কলকাতা: হাসিমারার জন্য নির্দিষ্ট ১৮টা রাফাল যুদ্ধবিমানের মধ্যে পাঁচটা ইতিমধ্যেই ভারতে চলে এসেছে। বর্তমানে সেগুলি রয়েছে অম্বালা বেসেই। সব ঠিকঠাক চললে আগামী এক-দুমাসের মধ্যে সেগুলি হাসিমারায় আসতে শুরু করবে। বায়ুসেনা সূত্রে এমনটাই খবর।


সময়টা ২০১৯ সালের জানুয়ারি। কেন্দ্র সরকার ঘোষণা করল, ভারতে রাফাল যুদ্ধবিমানের দুটি 'হোম বেস' হবে। একটি হরিয়ানার অম্বালা ও দ্বিতীয়টি পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা। 


তার তিন বছর আগে, অর্থাৎ, ২০১৬ সালেই ফ্রান্স থেকে সরাসরি ৩৬টা রাফাল মিডিয়াম মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্র্যাফ্ট (এমএমআরসিএ) কিনতে ৫৯ হাজার কোটি টাকার চুক্তি করে ফেলেছে মোদি সরকার। 


ইন্টার-গভর্নমেন্টাল কন্ট্র্যাক্টের মাধ্যমে ফরাসি যুদ্ধবিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা দাসো-র থেকে রাফাল কেনার চুক্তি হয়। দাসো হল রাফালের প্রস্তুতকারক সংস্থা।


এক জোড়া হোম বেসের নাম ঘোষণা হওয়া মাত্র, অম্বালা ও হাসিমারা-- এই দুই জায়গায় রাফাল-সহায়ক পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে যায়। 


অম্বালা প্রথম হোম বেস হওয়ায় সেখানকার কাজ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। সেখানকার জন্য নির্দিষ্ট ১৮টা যুদ্ধবিমান চলে এসেছে। স্কোয়াড্রন পুরোদমে অপারেশনাল হয়ে গিয়েছে। 


দ্বিতীয় হোম বেস অর্থাৎ হাসিমারার কাজ কিছুটা শ্লথ হয়ে যায় মাঝে কোভিড পরিস্থিতির জন্য। অতিমারীকালে সব কর্মকাণ্ড এলোমেলো হয়ে যায়। লকডাউনের জন্য অনেক সময় অপচয় হয়। অর্থের যোগানও স্তব্ধ হয়। তাতে কাজের গতি কমে যায়। কিন্তু, এখন সার্বিকভাবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায়, পুরোদমে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ হচ্ছে। 


বায়ুসেনা সূত্রে খবর, হাসিমারার বেস পুনর্গঠনের কাজ প্রায় শেষ। হ্যাঙার শেল্টার থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র সহ যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষ। 


এখন এই বায়ুসেনা ঘাঁটিকে অপারেশনাল করার আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কাজ চলছে বলে বায়ুসেনা সূত্রের খবর। নতুন রূপে সেজে উঠেছে হাসিমারা এয়ারফোর্স স্টেশন। নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে। রাফাল আসার পর তা নিশ্ছিদ্র করা হবে।


রাফাল যুদ্ধবিমান কীভাবে রাখা হবে, সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও ঠিক কেমন হবে, নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা আগেই দাসোর তরফে বলে দেওয়া হয়েছিল। সেই মতোই, গোটা এয়ারবেসের পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো হয়েছে। 



হাসিমারা এয়ারফোর্স স্টেশনের নতুন কমান্ডার এয়ার কমোডোর আশিস শ্রীবাস্তব। ছবি সৌজন্য- প্রতিরক্ষামন্ত্রক


গত সপ্তাহে হাসিমারা স্টেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন এয়ার কমোডোর আশিস শ্রীবাস্তব। ফাইটার পাইলট হিসেবে তাঁর বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। জাগুয়ার থেকে শুরু করে মিরাজ-২০০০, তেজস থেকে শুরু পণ্যবাহী--- প্রায় ১৮ ধরনের বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি একজন ক্যাটেগরি 'এ' পাইলট প্রশিক্ষক। 


কমোডোর আশিস শ্রীবাস্তব এর আগে বেজিংয়ে ভারতীয় দূতাবাসের 'এয়ার আতাশে' ছিলেন। যে কারণে, এখন চিন-সীমান্ত লাগোয়া হাসিমারার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। 


এর পাশাপাশি, গত সপ্তাহে হাসিমারার স্কোয়াড্রনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় রাফাল স্কোয়াড্রনের নাম হয়েছে '১০১ ফ্যালকন্স অফ ছাম্ব অ্যান্ড আখনুর'। 


প্রসঙ্গত, বায়ুসেনার এই স্কোয়াড্রনটি ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আগে এই স্কোয়াড্রনে মিগ-২১ বিমান থাকত। ২০১১ সালে এই স্কোয়াড্রন অবসর নেয়। এখন, রাফাল আসায় এই স্কোয়াড্রনকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। 


অম্বালায় এই নামকরণের অনুষ্ঠান হয়। বায়ুসেনা সূত্রের দাবি, আগামী এক-দুমাসের মধ্যেই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এই নতুন রূপের স্কোয়াড্রন। জানা গিয়েছে, ১০১ স্কোয়াড্রনের নেতৃত্বে থাকবেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন নীরজ ঝাম্ব। 


রায়ুসেনা সূত্রে খবর, সময়ের মধ্যেই ফ্রান্স থেকে বাকি বিমানগুলি চলে আসার কথা। অর্থাৎ, আগামী বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যেই ধাপে ধাপে ভারতের হাতে চলে আসবে পুরো ৩৬টা বিমান।


বায়ুসেনা সূত্রের দাবি, অবস্থানগত দিক গিয়ে আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত হাসিমারা এয়ারফোর্স স্টেশন ভারতের কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই ঘাঁটি ভারত-ভূটান-তিব্বত সংযোগস্থল (ট্রাই-জংশন) চুম্বি উপত্যকা থেকে একেবারে কাছে।


সাম্প্রতিক অতীতে, নাথু লা-র নিকটে অবস্থিত এই ট্রাই-জংশনে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে চিন। যা নিয়ে দুদেশের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক ও সামরিক সংঘাত দেখা দিয়েছিল। বরাবরই, এই জায়গাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। 


ফলে, এখানে বায়ুসেনা ঘাঁটি থাকলে শক্তি বৃদ্ধি হবে ভারতের। উপরন্তু, তিব্বতে যত চিনা বায়ুসেনা ঘাঁটি রয়েছে, সবকটি রাফালের নিশানার মধ্যে চলে আসবে। 


বায়ুসেনার এক সূত্রের দাবি, হাসিমারায় কবে রাফাল আসবে, তা নির্ভর করছে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। প্রথমত, এই ঘাঁটির নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক (এয়ার কমোডোর) দিল্লিতে বায়ুসেনার সদর দফতরে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাঠাবেন। 


সেটা হওয়ার পরই চূড়ান্ত ক্লিয়ারেন্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তখনই জানা যাবে, কবে এই বিমান হাসিমারার মাটি ছোঁবে। তবে, আশা করা যায়, দুমাসের মধ্যে কিছু একটা হবে।


ওই সূত্র যোগ করেন, একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, রাফালের হাসিমারা আসাটা শুধুমাত্র লজিস্টিক্যাল নয়, স্ট্র্যাটেজিকাল সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, এই সিদ্ধান্ত একেবারে শীর্ষস্তরে নেওয়া হবে। তাই, সঠিক সময় আগাম বলা সম্ভব নয়। 


১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর হাসিমারা বিমান ঘাঁটি গড়া হয়েছিল। সেই সময় এই ফরাসি সংস্থা দাসো নির্মিত তুফানি বিমান এখান থেকেই উড়ান নিয়েছিল। পরে, রুশ নির্মিত মিগ-২৭ বিমান এখান থেকে উড়েছে। এখন রাফালের অপেক্ষায় হাসিমারা।