কলকাতা: কলকাতা থেকে হিসেব করলে গুগল বলছে দূরত্বটা ৮০৯৬ কিলোমিটার। যেতে-আসতে লাগে অনেকটা সময়। কিন্তু এই বিপুল দূরত্ব বাঙালির নাড়ির টান ছিঁড়তে পারে না। বিশেষ করে সেই টান যদি দুর্গাপুজোর হয়ে থাকে। দুর্গাপুজো আর বাঙালি যে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় UK-এর বর্নমাউথ (Bournemouth)। বাংলা থেকে এত দূরেও তিথি-নক্ষত্র মেনে, সমস্ত উপাচার- সাজিয়ে পুজো হয় দেবী দুর্গার। আর এই সমস্ত আয়োজনই করা হয় Dorset Indian Association (সংক্ষেপে DIA) -নামের একটি সংগঠনের তরফে। যা মূলত বর্নমাউথের প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন। বছরভর নানারকম স্বেচ্ছাসেবী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকে এ সংগঠন। আর আয়োজন করে শারদোৎসবের। 


এক পা-দু'পা করে:
উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এই সংগঠনের পুজো শুরু করার গল্পটাও চমৎকার। ৫টা পরিবার নিয়ে সংগঠন তৈরি হয়। ২০১২-১৩ সাল নাগাদ তারা প্রথম সরস্বতী পুজো করেন। তারপরে ধীরে ধীরে বেড়েছে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা। সংগঠনের কলেবরও বেড়েছে। এখন বহু সদস্য রয়েছেন। ২০১৬ সাল থেকে টানা দুর্গাপুজোর আয়োজন করে আসছেন এখানকার প্রবাসী বাঙালিরা। একেবারে প্রথম বছর ছোট্ট একটি মূর্তিতে পুজো হয়েছিল। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে কুমোরটুলি থেকে আনানো হয়েছিল ফাইবারের প্রতিমা। তাতেই হয় পুজো। এবারও জাঁকজমকের সঙ্গে বর্নমাউথে আয়োজন হচ্ছে দুর্গাপুজোর। ১ থেকে ৫ অক্টোবর, সব রীতি-নীতি মেনে আয়োজিত হতে চলেছে দুর্গাপুজোর। শুধু বাঙালি নন, অন্য প্রদেশের প্রবাসী ভারতীয়রাও সমান উৎসাহে মেতে ওঠেন এই দুর্গাপুজোয়। একেবারে আর পাঁচটা বারোয়ারি পুজোর মতোই সকলে চাঁদা দিয়ে আয়োজন করেন পুজোর।


বছরভর প্রস্তুতি:
বছরের প্রথমেই বাঙালির চোখ যায় ক্যালেন্ডারে। দুর্গাপুজো দিনক্ষণ জানতে। বর্নমাউথের প্রবাসী বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নন। পুজোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম রোহন সেন জানাচ্ছেন, যেহেতু ঠিকমতো তিথি-নক্ষত্র মেনে পুজো হয়। তাই সময়ের একটুও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ব্রিটেনে তো সেভাবে ছুটি পাওয়া যায় না। তাই উদ্যোক্তাদের সবাই বছরের প্রথমেই প্ল্যান করে নেন। কে কোনদিন ছুটি নেবেন তা প্ল্যান করে সেই ভাবে ব্যবস্থা করা হয়। সেই ছুটির দিনগুলিতে নির্দিষ্ট করে পুজোর দায়িত্বের ভাগ পড়ে।
দুর্গাপুজোর কাজও থাকে বহু। দশকর্মা থেকে পুজোর আরও নানা উপাচার। ফুল থেকে ধূপধুনো। বিদেশ-বিঁভুইয়ে এসব জোগাড় করা খুব সহজ কাজ না। পাওয়া গেলেও বেশ খানিকটা চড়া দাম হয়। তবুও সমস্ত কিছুই জোগাড় করা হয়। ব্যবস্থা করা হয় ফুলেরও। অন্যতম উদ্যোক্তা রোহন সেন জানাচ্ছেন, সেখানে মালা পাওয়া যায় না। ফলে ফুলের তোড়া কিনে সদস্যরাই নিজে হাতে মালা তৈরি করেন। পুজোর চারদিন, প্রতিদিন সকালে চলে মালা তৈরির কাজ। তোড়া থেকে ফুল খুলে তা দিয়ে মালা তৈরি করে পুজোর আয়োজন হয়। হাতে হাতে গোছানো হয় যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস। বর্নমাউথের দুর্গাপুজোর পৌরহিত্যের দায়িত্ব সামলান লন্ডননিবাসী প্রলয় মুখার্জি। অফিস ছুটি নিয়ে তিনি এখানে পুজো করেন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি পুজো করছেন বলে জানাচ্ছেন অন্যতম উদ্যোক্তা রোহন সেন।    


 



আগের বছরের পুজো।


 


হাতে হাতে রান্না:
শুধু মালা গাঁথা নয়, হল ডেকরেশন থেকে পুজোর দিনে খাওয়া-দাওয়া সবই সদস্যরা নিজে হাতে করেন। কীভাবে এত বড় কাজ সামলানো হয়? তার পিছনেও থাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, যেহেতু সংগঠনটির অনেক সদস্য। তাই প্রত্যেকেই কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসেন। আগে থেকে পরিকল্পনা করে ভাগে ভাগে এভাবেই সব খাবার তৈরি করা হয়। যে হলে পুজো হয়, সেখানেও রান্নার ব্যবস্থা থাকে। সারাদিনের পরিশ্রম, অফিসের ব্যস্ততা সামলেও বছর বছর এভাবেই খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্বও সামলানো হয়, জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। 


গান-নাচ-আবৃত্তি:
উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, ব্রিটেনের মাটিতে হলেও বর্নমাউথের পুজো একেবারে পাড়ার পুজোর কথা মনে পড়াতে বাধ্য। তাই নিয়ম মেনেই থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কয়েকজনের উপর দায়িত্ব থাকে। তাঁরাই যাবতীয় আয়োজনের কাজ করে থাকেন। কাজের ফাঁকে চলে রিহার্সাল। এবার দশমীর দিন কিছু বাচ্চাদের নিয়ে একটি নাচের অনুষ্ঠান হবে। পাশাপাশি, যে কেউ ইচ্ছেমতো গান গাইতে পারেন, বসে ঘরোয়া আবৃত্তির আসরও। আর দশমীতে হয় চুটিয়ে সিঁদুর খেলা।


আরও পড়ুন: জার্মানির বুকে বাংলার সেরা উৎসব, সৌজন্যে বার্লিন সর্বজনীন