কলকাতা: ১২৭৫ খ্রীষ্টাব্দে আরব ইঞ্জিনিয়ার হাসান আল-রম্মাহ-- যিনি মিশরের মামলুক সালতানাতের সামরিক বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করেছিলেন, তিনি একবার লিখেছিলেন যে, এমন একটি বস্তু তৈরি করা সম্ভব যা ডিম্বাকৃতির মতো হবে, যা জলের তলায় চলতে সক্ষম হবে এবং তা থেকে আগুন বের হবে। 


আধুনিক যুদ্ধে টর্পেডো হলো সাবমেরিন, জাহাজ বা বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য একটি সিগার-আকৃতির, স্ব-চালিত, জলের নীচে চলতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র, যা একটি যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ, জলের তলা দিয়ে জাহাজ ও সাবমেরিন বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের অপর নাম হল টর্পেডো। 


কেন এই নামকরণ?


টর্পেডো শব্দটি এসেছে এক বিশেষ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ -- ইলেক্ট্রিক রে থেকে। ওই প্রজাতিকে টর্পেডো বা ইলেক্ট্রিক রে বা  টর্পেডো রে বলা হয়। এই বিশেষ প্রজাতির মাছটি শরীরে উৎপন্ন ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে শত্রুকে অকেজো করে দেয়। 


১৯ শতকের সময় কিছু জাহাজে স্পার টর্পেডো ব্যবহার করত, যা ছিল একটি দীর্ঘ দণ্ড বা স্পারের শেষে যুক্ত একটি বিস্ফোরক চার্জ। শত্রু জাহাজ কাছে এলে ওই ঘষা লেগে দণ্ডের সামনে লাগানো বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটত আর সেই জাহাজটি ফুটো হয়ে ডুবে যেত। আধুনিক টর্পেডোর জনক বলা হয় ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট হোয়াইটহেডকে। ১৮৬৬ সালে তিনিই প্রথম সফলভাবে তৈরি করেছিলেন টর্পেডো। 


টর্পেডোর প্রজাতি


প্রপালসন শক্তির উৎস, জলের নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, কোন লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে হবে, তার ধরন এবং কোন ধরনের যান থেকে ওই টর্পেডো নিক্ষেপ করা হচ্ছে --- এই চার বিষয়ের ওপর নির্ভর করে আধুনিক টর্পেডোগুলির শ্রেণিবিন্যাস করা হয়ে থাকে। 


প্রপালশন সাধারণত ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা হয়। জলের নীচ দিয়ে টর্পেডোর যাত্রা বিভিন্ন উপায়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন, অ্যাক্টিভ-অ্যাকোস্টিক টর্পেডোগুলি সোনার (শব্দ সঙ্কেত) সিগন্যাল ছোড়ে। সেই সিগন্যাল লক্ষ্যবস্তুতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসলেই, টর্পেডো বুঝে যায় লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান।  অন্যদিকে, প্যাসিভ-অ্যাকোস্টিক টর্পেডোগুলি লক্ষ্যবস্তুর দ্বারা তৈরি আওয়াজকে অনুসরণ করে। 


টর্পেডোর প্রয়োজনীয়তা


বর্তমান যুগে, যে কোনও দেশের নৌবাহিনীর অন্যতম নির্ভরযোগ্য অস্ত্র হল টর্পেডো। বিশেষ করে শত্রু সাবমেরিনকে ধ্বংস করতে এটিই প্রধান অস্ত্র। বিশ্বের তামাম নৌসেনা হরেক রকমের টর্পেডো ব্যবহার করে থাকে। সেগুলি বিভিন্ন শ্রেণির। শক্তি ও ক্ষমতা বিচার করেও অনেক সময় বিন্যাস করা হয় টর্পেডো। 


এবার আসা যাক ভারতের প্রসঙ্গে। ভারতীয় নৌসেনা দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশ থেকে টর্পেডো আমদানি করত। কিন্তু, একটা সময় সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে তুমুল দুর্নীতির কালো ছায়ায় ঢাকা পড়েছিল দেশে। 


বিদেশি প্রস্তুতকারী সংস্থার বিরুদ্ধে তখন উঠছিল একের পর এক ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ। তখন সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনা প্রায় থমকে গিয়েছিল। সেই সময় দেশের টর্পেডোর সংখ্যা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল। 


পরবর্তীকালে, ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, বিদেশ থেকে নয়। এবার দেশে দেশীয় প্রযুক্তিতেই তৈরি করা হবে টর্পেডো। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি কোমর বেঁধে নেমে পড়ে দেশীয় টর্পেডো তৈরি করতে। 


ভারতের নিজস্ব টর্পেডো


২০১৬ সালে ভারতে নির্মিত প্রথম হেভিওয়েট টর্পেডো (এইচডব্লুটি) নৌসেনার হাতে তুলে দেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর। টর্পেডোটি তৈরি করেছে ডিআরডিও-র অধিনস্থ সংস্থা নেভাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি (এনএসটিএল)। 


টর্পেডোর নাম রাখা হয় "বরুণাস্ত্র"। হিন্দুধর্মে জলের দেবতা হলেন বরুণদেব। তাই তার নামেই রাখা হয় টর্পেডোর নাম। এটি অত্যাধুনিক হেভিওয়েট সাবমেরিন-বিধ্বংসী টর্পেডো, যা জাহাজ থেকে নিক্ষেপ করা হয়। 


নৌসেনার সূত্রে খবর, বরুণাস্ত্রকে বাহিনীর প্রতিটি সাবমেরিন-বিধ্বংসী জাহাজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই তালিকায় রয়েছে -- দিল্লি-ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, কলকাতা-ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, রাজপুত-ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, কামোর্তা-ক্লাস করভেট, তলওয়ার-ক্লাস ফ্রিগেট ইত্যাদি। 


পরবর্তীকালে, বরুণাস্ত্র-র আরও একটি সংস্করণ তৈরি করেছে ভারত। এটি আবার সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপ করা যায়। নাম রাখা হয়েছে "তক্ষক"। বর্তমানে সিন্ধুঘোষ-ক্লাস (ডিজেল-ইলেক্ট্রিক চালিত) সাবমেরিনে এই টর্পেডোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। 


এই তক্ষক টর্পেডোর আবার দুটি সংস্করণ রয়েছে -- একটি জাহাজ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ওয়ার-গাইডেন্স সমেত। দ্বিতীয়টি সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য অটো-গাইডেন্স সহ। 


এখনও বিদেশ থেকে টর্পেডো আমদানি করতে হয় ভারতকে। তবে, এখন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার পদ্ধতি অনেকটাই স্বচ্ছ হওয়ায়, প্রক্রিয়াও সহজ হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু, দেশে সংখ্যাও অনেকটাই কমানো হয়েছে। 


বিশ্বে ভারত অষ্টম দেশ, যারা নিজস্ব টর্পেডো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। নৌসেনার জন্য এনএসটিএল আরও একটি ভিন্ন ধরনের টর্পেডো নির্মাণ করেছে। সেটি লাইটওয়েট টর্পেডো (এলডব্লুটি), অর্থাৎ হাল্কা ওজনের। নাম রাখা হয়েছে "শৈন"। এটি জাহাজ, সাবমেরিন, হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষেপযোগ্য। 


এর পাশাপাশি, ভারতে আরও দুটি নতুন ধরনের টর্পেডো নিয়ে গবেষণা চলছে। যেগুলিকে বলা হচ্ছে গেম চেঞ্জার। অর্থাৎ, যা একবার অন্তর্ভুক্ত হলে, ভারত গোটা বিশ্বের সমীহ আদায় করে নেবে। টর্পেডো-যুদ্ধে ভারত একলাফে অনেকটা এগিয়ে যাবে।


প্রথম টর্পেডোর সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। এই টর্পেডোর সম্ভাব্য নাম শক্তি। এতে রয়েছে থার্মাল প্রোপালসনের প্রযুক্তি, যা এক সেকেন্ডের মধ্যে ৫০০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করতে সক্ষম। 


প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। বিশ্বে মাত্র তিনটি দেশ এই প্রযুক্তি নির্ভর টর্পেডো রয়েছে-- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ব্রিটেন। 


দ্বিতীয় প্রযুক্তি আরও উন্নত। গতবছর, ওড়িশা উপকূলে হুইলার দ্বীপ থেকে ভারত এর পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করে ফেলেছে। ডিআরডিও-র তত্ত্বাবধানে হওয়া এই গবেষণার নাম দেওয়া হয়েছে "স্মার্ট"। পুরো অর্থ সুপারসনিক মিসাইল অ্যাসিস্টেড রিলিজ অফ টর্পেডো (SMART)। 


কী এই স্মার্ট?


প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্মার্ট টর্পেডো সিস্টেম হলো একটি হাইব্রিড প্রযুক্তি, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ও টর্পেডোর প্রযুক্তির মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। স্মার্ট টর্পেডো সেই সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে, যেখানে সাধারণ টর্পেডো পৌঁছতে পারবে না।


যে কোনও টর্পেডোর একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব সীমা থাকে। সাধারণত, যা নিক্ষেপস্থল থেকে ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার মধ্যে হয়। অর্থাৎ, লক্ষ্যবস্তুকে এই সীমার মধ্যে হতে হবে। তবেই আঘাত হেনে শত্রুর সাবমেরিন ধ্বংস করতে পারবে টর্পেডো।


কিন্তু, এর বাইরে হলে কী হবে? তার জবাব হতে পারে স্মার্ট। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টর্পেডোর রেঞ্জের বাইরে কোনও অভিযান করতে হলে, স্মার্ট - একমাত্র বিকল্প। 


প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে দাবি, কোনও জাহাজ বা সৈকতে রাখা মাউন্টেড ট্রাক থেকে নিক্ষেপ করা হলে, স্মার্ট প্রথম পর্যায়ে সুপারসনিক (শব্দের চেয়ে দ্রুত) ক্রুজ ক্ষেপণস্ত্রের গতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠ-ঘেঁষে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যাবে।


এই সময় যুদ্ধজাহাজ বা আকাশে চক্কর কাটা সাবমেরিন নজরদারি বিমান (পসেইডন -পি৮আই)-এর সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ রেখে চলবে স্মার্ট। জাহাজ বা বিমান শত্রু সাবমেরিনের থেকে সঠিক নিশানা পেলে, শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়।


এখানে, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্রর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবে টর্পেডো (এলডব্লুটি)। প্যারাশ্যুটের মাধ্যমে গতি কমিয়ে 'ড্রপ' করা হয় জলে। এবার সে সাধারণ টর্পেডোপর মতো কাজ করতে শুরু করবে। 


এক্ষেত্রে মূল তফাৎ হচ্ছে দূরত্ব। লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরত্বের প্রায় ৯০ শতাংশ পথ টর্পেডোকে পেটে নিয়ে বহন করে পৌঁছে দেবে স্মার্ট। ফলে, অপারেশনাল রেডিয়াস বেড়ে হবে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, একলাফে ১৩ গুণ দূরত্ব বৃদ্ধি।