শ্রীহরিকোটা: উৎক্ষেপণের পাঁচ মিনিটের মাথায় মাঝ-আকাশেই ভেঙে পড়ল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল-এফ১০ (জিএসএলভি-এফ১০) রকেট। যান্ত্রিক গোলযোগের জন্যই দুর্ঘটনা, ট্যুইট করে জানিয়েছে ইসরো। আজ ভোর ৫টা ৪৩ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধবন স্পেস সেন্টার থেকে জিএসএলভি-এফ১০ রকেটে চড়ে মহাকাশে রওনা দেয় উপগ্রহ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট-০৩ (ইওএস-০৩) উপগ্রহ।
কিন্তু উৎক্ষেপণের ১৫ মিনিট পর যাত্রার তৃতীয় স্তরে পৌঁছনোর পর ভেঙে পড়ে এই উপগ্রহ। ভেঙে পড়ার আগে বিজ্ঞানীরা দেখেন, নির্ধারিত পথ থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে জিএসএলভি-এফ১০। ইসরো সূত্রে খবর, প্রথম দুটি স্টেজ বা পর্যায় ঠিকঠাক এগিয়েছে। সময়মতো, প্রথম পর্যায়ে রকেটের চারদিকে লাগানো স্ট্র্য়াপ-অন বুস্টার জ্বলেছে এবং সময়মতো তা মূল অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের ফায়ারিং ও সেপারেশনও ঠিক হয়েছিল। গণ্ডগোল বাধে তৃতীয় পর্যায়ে এসে। ইসরো সূত্রে খবর, লিফ্ট-অফ বা উৎক্ষেপণের ৪ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড পর চালু হওয়ার কথা ছিল তৃতীয় ক্রায়োজেনিক স্টেজের। জানা গিয়েছে, সেটিই ঠিক মতো কাজ করেনি। অর্থাৎ, ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন চালু হয়নি। যে কারণে, করেট দ্রুত তার গতি হারাতে শুর করে। একইসঙ্গে উচ্চতাও। একটা সময় রকেট তার পূর্ব-নির্ধারিত পথ থেকে অনেকটাই সরে আসে।
ফলে বাধ্য হয়ে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয় মিশন কন্ট্রোল রুমে বসে থাকা বিজ্ঞানীদের। ব্যবহার করতে হয় "কিল সুইচ"। অর্থাৎ, রিমোট ডেটোনেশনের মাধ্য়মে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া রকেটটিকে। এখানে বলে রাখা দরকার, গত এক বছর ধরেই উপগ্রহ পাঠানোর তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছিল ইসরো।
কী এই ক্রায়োজেনিক স্টেজ?
ক্রায়োজেনিক স্টেজ হল যে কোনও মহাকাশ উৎক্ষেপণকারী যানের যাত্রাপথের শেষ পর্যায়। এই পর্যায়ে অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় তরল জ্বালানি ব্যবহার করে মহাকাশে ভারী বস্তু তাদের সঠিক কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করা হয়।
ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন হল অত্য়ন্ত শক্তিশালী। এতে তরল অক্সিজেন এবং তরল হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উভয় জ্বালানি তাদের নিজ নিজ ট্যাঙ্কে সংরক্ষিত থাকে। সেখান থেকে পৃথক বুস্টার পাম্পের মাধ্যমে টার্বো পাম্পের মধ্যে অত্যন্ত শক্তি দিয়ে পাঠানো হয় দুই জ্বালানিকে, যাতে দহন চেম্বারের ভেতরে প্রোপেলেন্টের উচ্চ প্রবাহ নিশ্চিত হয়।
ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন সাধারণত তরল অক্সিজেন ব্যবহার করে, যা মাইনাস ১৮৩ (-১৮৩) ডিগ্রি সেলসিয়াসে তরল হয় এবং তরল হাইড্রোজেন, যা মাইনাস ২৫৩ (-২৫৩) ডিগ্রি সেলসিয়াসে তরল হয়। তরল হাইড্রোজেন জ্বালানি হিসেবে কাজ করে যখন তরল অক্সিজেন অক্সিডাইজার হিসেবে কাজ করে। এই দুইয়ের মিশ্রণে তীব্র প্রদাহ তৈরি হয়, যা রকেটকে গতি দেয়। যখন ইঞ্জিনটি জ্বলতে থাকে, তখন দুটি তরলকে বুস্টার পাম্প দ্বারা ক্রমাগত একটি জ্বলন চেম্বারে ঠেলে দেওয়া হয়।
ইসরো বলেছে, কঠিন বা সাধারণ তরল জ্বালানি নির্ভর স্টেজের তুলনায় ক্রায়োজেনিক পর্যায়ের কার্যপদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। কারণ, এখানে জ্বালানিকে প্রচণ্ড কম তাপমাত্রায় কৃত্রিমভাবে তরল আকারে রাখা হয়। ফলে, তাপ ও কাঠামো সম্পর্কিত সমস্যা দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
ইসরোর ক্রায়ো স্টেজ ইঞ্জিনের নাম সি২৫। এই সি২৫-এর জ্বালানি ট্যাঙ্কে প্রায় ২৭ হাজার কেজি তরল জ্বালানি মজুত থাকে যা ৭২০ সেকেন্ড বা ১২ মিনিট ধরে ইঞ্জিনকে জ্বলতে সাহায্য করে। এর আগে, চন্দ্রযান-২ মিশনের সময়ও ইসরো এই ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের ব্যবহার করেছিল। ভারত বাদে বিশ্বের আর ৫টি দেশের নিজস্ব ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন আছে-- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স (ইউরোপীয় এজেন্সি), রাশিয়া, চিন ও জাপান।
কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই উৎক্ষেপণ?
অত্যাধুনিক ইমেজিং ইওএস-০৩ উপগ্রহ ভারতের জন্য একটি "গেম চেঞ্জার" হিসেবে প্রমাণিত হতো। এতে ছিল উচ্চ রেজোলিউশন সম্পন্ন ক্যামেরা, যা ভারতের স্থলভূমি এবং সমুদ্র অঞ্চলে নিরন্তর, রিয়েল-টাইম নজরদারি করতে সক্ষম ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে দেশের প্রতিরক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে এই উপগ্রহ অত্যন্ত কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। কারণ, দেশের সীমান্তঞ্চল থেকে লাইভ ছবি প্রাপ্ত হলে, তাতে নিরাপত্তাবাহিনীর লাভ হতো।
এছাড়া, এই উপগ্রহর পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কমাতে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব হতো। পাশাপাশি ইসরো জানিয়েছিল, ইওএস-০৩ উপগ্রহটি কৃষি, বনপালনবিদ্যা, খনিজবিদ্যা, মেঘের বৈশিষ্ট্য, তুষার এবং হিমবাহ এবং সমুদ্রবিদ্যা মতো বিভিন্ন বিষয়ে পৃথক চিহ্ন ব্যবহার করতে সক্ষম।
লো আর্থ অরবিট (এলইও) বা নিচু কক্ষপথে ৫ টন পর্যন্ত পেলোড এবং জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটে ২.৫ টন পর্যন্ত পেলোড রাখার ক্ষমতা রয়েছে জিএসএলভির। বৃহস্পতিবার লঞ্চটি ইওএস-০৩ উপগ্রহকে জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটে রাখার উদ্দেশ্য ছিল।