ত্রিথেশ নন্দন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে (Russia Ukraine War) গোড়া থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান ভারতের। যুদ্ধবিরতির বাতিলের আর্জি জানিয়েও রাষ্ট্রপুঞ্জে (United Nations) রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে দিল্লি। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক চোখরাঙানি এগিয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি আগে থেকে বাড়ানোও হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিগত ১০০ দিনে তার কম মাশুল গুনতে হয়নি ভারতকে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, টাকার দামে পতন, সবমিলিয়ে জেরবার দেশের অর্থনীতি (War Cost for India)।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাশুল ভারতের ঘাড়েও
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শুক্রবার, ৩ জুন সেই যুদ্ধ ১০০ দিনে পদার্পণ করেছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এ বছর জানুয়ারি মাসে ভারতে গ্রাহক নির্ভর মুদ্রাস্ফীতির (Consumer Price Index/CPI) হার ছিল ৬.০১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৬.০৭ শতাংশে এসে ঠেকে। মার্চ মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে হয় ৬.৯৫ন শতাংশ। আর এপ্রিলে তা আরও বেড়ে ৭.৭৯ শতাংশ হয়। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যাবন এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন মন্ত্রক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ১০০ দিনে দেশে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বিশেষত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে অত্যধিক হারে।
অতি সম্প্রতি পড়শি দেশ শ্রীলঙ্কার অস্থির পরিস্থিতি খবরের শিরোনামে উঠে আসে। তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয় দেশে। অতি সাধারণ খাদ্যপণ্যের দাম সমস্ত সীমা অতিক্রম করে। তার জেরে খাদ্য সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হয়। সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকেও রসদ করার উপায় ছিল না শ্রীলঙ্কার।
ভারতের সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রার পরিমাণও আশঙ্কা তৈরি করছে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মনে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি পাওয়া তথ্য অনুসারে, ভারতের সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রার আনুমানিক মূল্য যেখানে ছিল ৬৩২ বিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৭.২৫ লক্ষ কোটি টাকা), ২০ মে হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, তা কমে ৫৯৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছে, ভারতীয় মুদ্রায় যা ৪৬.৩৮ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারতের সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রায় ৫.৩৮ শতাংশ পতন ঘটেছে।
একই সঙ্গে ডলার প্রতি টাকার দামেও উল্লেখযোগ্য হারে পতন চোখে পড়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ডলার প্রতি টাকার দাম ছিল ৭৪ টাকা ৬২ পয়সা। ২৩ জুন তা এসে ঠেকে ডলার প্রতি ৭৭ টাকা ৫৬ পয়সায়। স্বাভাবিক ভাবেই বাজারের উপরও তার প্রভাব পড়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে সেনসেক্স ৫৭,২৩২-তে। ৩ জুন তা নেমে আসে ৫৬,২৭১-এ। এ বছর জুন মাসে দেশের অভ্যন্তরীণ গড় উৎপাদন দাঁড়িয়েছিল ৭.২ শতাংশে। এ বছর জুন মাসে ভারতে বেকারত্বের হার ৭.২ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন: Religious Freedom Report: ২০২১-এ বছরভর সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, বলছে মার্কিন রিপোর্ট
দেশের অন্দরে এবং পড়শি দেশের চাহিদার জোগান অব্যাহত রাখতে মে মাসে গম রফতানি বন্ধ করে দেয় কেন্দ্র। অথচ তার আগেই গোটা বিশ্বের সামেন ভারতকে অন্নদাতা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে দিল্লির তরফে যুক্তি দেওয়া হলেও, আন্তর্জাতিক মহলে কথার খেলাপের অভিযোগ ওঠে ভারতের বিরুদ্ধে। বর্তমানে দেশের গাড়িশিল্পও কার্যত ধুঁকছে। যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানি প্রায় বন্ধের মুখে।
গোটা বিশ্বেও এই যুদ্ধের সার্বিক প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুদ্ধের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত দিনে কমপক্ষে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। ইউক্রেনে রুশ হামলা এখনও পর্যন্ত কমপক্ষে ২৪৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৪৪৬ শিশু। সবমিলিয়ে ৪ হাজার ১৪৯ ইউক্রেনীয় নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৪৫ জন। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যা আরও বেশি বলে মত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের।
যুদ্ধ শুরু পর থেকে এখনও পর্যন্ত ইউক্রেনের অন্দরেই ৭৭ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। মোট জনসংখ্যার নিরিখে প্রতি ছ’জনের মধ্যে একজন নাগরিক ঘরছাড়া। অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন কমপক্ষে ৬৮ লক্ষ ইউক্রেনীয়, এমনটাই দাবি রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী বিভাগের।
যুদ্ধের প্রভাবে ধস নেমেছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডাদের অনুমান, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে ৮.৫ শতাংশ সঙ্কোচন ঘটবে। যুদ্ধে সেনা এববং মানবিক ত্রাণে এখনও পর্যন্ত ৮.৩ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ৬৪ হাজার ৪০৫ কোটি খরচ হয়েছে ইউক্রেনের। যুদ্ধে পরিকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৭ কোটি ৭৬ লক্ষ কোটি টাকা।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত রাশিয়া, ইউক্রেন, দুই দেশই
তবে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে অনুমান করা হচ্ছে। যুদ্ধ চালাতে গিয়ে শুধুমাত্র সরঞ্জামের ক্ষয়ক্ষতিবাবদই ১৩ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা ডুবেছে তাদের। সবমিলিয়ে ৪৬টি দেশ তাদের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৭৮২টি নিষেধাজ্ঞা চেপেছে তাদের উপর, যাতে গোটা বিশ্বে সর্বাধিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত দেশে পরিণত হয়েছে রাশিয়া।