নয়াদিল্লি: সংশোধিত বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন (২০২০) (FCRA Amendments 2020  Foreign Contribution (Regulation) Act 2010)  নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) স্বস্তি কেন্দ্রীয় সরকারের। ২০১০ সালের ওই আইনে নরেন্দ্র মোদি সরকারের ঘটানো সংশোধনে ছাড়পত্র দিল আদালত। আদালত জানিয়েছে, বিদেশি অনুদান পাওয়ার মৌলিক এবং নিরঙ্কুশ অধিকার নেই কারও। অতীতে বিদেশি অনুদানের টাকার অপব্যবহারের নজির রয়েছে, তাই কড়া হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা আবশ্যক বলে জানিয়েছে শীর্ষ আদালত।


এ বছরের গোড়ায় সংশোধিত আইনের প্রকোপে পড়ে বহু সংস্থা


২০২০-র সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধন ঘটায় কেন্দ্রীয় সরকার। তার পর ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিদেশি অনুদান পাওয়ার ছাড়পত্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু এ বছরের গোড়ায় মাদার টেরিজার মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজ-এর মতো বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার (Foreign Funding for NGOs)  বিদেশি অনুদান পাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে কেন্দ্র জানায়, বিদেশি অনুদান পেতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ছাড়পত্রে পুনর্নবীকরণও করাতে হয়। যে সমস্ত সংস্থা তা করেনি, তাদের অনুদান পাওয়ার রাস্তা  বন্ধ করা হয়েছে। যদিও পরে মাদার টেরিজার সংস্থাকে অনুদান পাওয়ার যোগ্য তালিকায় ফেরানো হয়।  


বিদেশি অনুদান আইনে এই সংশোধনের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে একাধিক পিটিশন জমা পড়েছিল। আবেদনকারীদের অভিযোগ ছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির উপর কঠোর এবং অত্যধিক বিধিনিষেধ চাপানো হয়েছে। বিদেশি অনুদান গ্রহণ এবং তার ব্যবহারেও প্রভাব ফেলবে এই আইন।


কিন্তু শুক্রবার সেই আবেদনগুলির শুনানি করতে গিয়ে আদালত জানিয়েছে, বিদেশি অনুদান গ্রহণে শর্তহীন অধিকার নেই কারও। বিদেশি অনুদান যে দেশের জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তা সর্বজনবিদিত। এতে দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামো অভূতপূর্ব ভবে প্রভাবিত হয়।


কেন্দ্রীয় সংশোধনীর বিরুদ্ধে আদালতে পিটিশন জমা দিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কেয়ার অ্যান্ড শেয়ার’-এর নোয়েল হার্পার, ‘জীবন জ্যোতি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর মতো সংস্থা। ছাড়পত্র পাওয়ার যে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্র, তাকে চ্যালেঞ্জ জানান বিনয় বিনায়ক জোশী। কিন্তু সরকারের হয়ে আদালতে সওয়াল-জবাব করতে গিয়ে সলিশিটর জেনারেল তুষার মেহতা যুক্তি দেন যে, দেশের অন্দরে নকশাল ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে নিয়ে যেতেও বিদেশ থেকে টাকা আসতে পারে। দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে তাতে। নকশালদের প্রশিক্ষণ দিতে বিদেশি অনুদানের টাকা যে ঘুরপথে ব্যবহৃত হয়, গোয়েন্দাদের থেকে তেমন তথ্য ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে বলেও দাবি করেন মেহতা।


আদালতে সওয়াল-জবাব 


অন্য দিকে, আবেদনকারীদের আইনজীবী গোপাল শঙ্করানারায়ণন নয়া বিধির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। তাঁর প্রশ্ন, দিল্লিতে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রধান শাখা হয়ে বিদেশি অনুদানের টাকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে কেন্দ্র। কিন্তু সেখান থেকে যে টাকা নাশকতামূলক কাজে ব্যবহার করা হবে না, তা কোন উপায়ে নিশ্চিত করা হবে? দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে শিশুশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির পক্ষে এই উপায়ে কী ভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, তাও জানতে চান তিনি।  


দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব শোনার পর গত ৯ নভেম্বর রায়দান স্থগিত রেখেছিল শীর্ষ আদালত। কিন্তু শুক্রবার রায় শোনাতে গিয়ে আদালত জানায়, বিদেশি অনুদানের টাকা দেশের নীতি-নিয়মকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি এর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক আদর্শকেও চালিত করা সম্ভব। তাই অনুদানের টাকা কোথা থেকে আসছে, কোন ক্ষেত্রে তা খরচ হচ্ছে, তার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকার যুক্তি যথাযোগ্য বলে মনে হচ্ছে আমাদের। দেশের সার্বভৌমিকতা এবং গণতন্ত্র রক্ষায়, সাধারণ মানুষের স্বার্থে এই সংশোধন কার্যকরী বলেও জানায় আদালত।



মাদার টেরিজার সংস্থাকে নিয়ে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েনের টুইট সেই সময়কার টুইট


আরও পড়ুন: Cardless Cash Withdrawal: কার্ডলেস এটিএম লেনদেনে জোর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের, আপনার কী লাভ জানেন


আবেদনকারীদের তরফে যুক্তি দেওয়া হয় যে, এই মুহূর্তে দেশে যত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে, তার অর্ধেক গড়ে ওঠে কোভিডের সময়। সংশোধিত আইনে স্বাধীন ভাবে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হবে না। জবাবে বিচারপতি এএম খানউইলকর জানান, কোন কাজে টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেই সম্পর্কে যাতে সরকার অবগত থাকে, তার জন্যই আইনে সংশোধন ঘটানো হয়েছে। তা যদি জানানো না যায়, তাহলে সরকারের পক্ষেও অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়।


সংশোধিত বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে বিতর্কের কারণ


উল্লেখ্য, সংশোধিত আইনে বিদেশি অনুদান পেতে হলে প্রত্যেক সংস্থার নাম নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারি আধিকারিক, কর্মী, বিচারপতি এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংগঠনে নিযুক্ত কেউ বিদেশি অনুদান পাওয়ার যোগ্য নন। বিদেশি অনুদানের টাকা শুধুমাত্র নতিভুক্ত সংস্থাগুলির মধ্যেই লেনদেন করা যাবে। সংস্থায় কর্মরত কর্মীদের বেতন, যাতায়াতের খরচ, জল, বিদ্যুৎ, ফোন বিল, ডাক পরিষেবা, ঘরভাড়া, মেরামতির কাজে এত দিন বিদেশি অনুদানের ৫০ শতাংশ টাকা ব্যবহার করতে পারত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। তা কমিয়ে ২০ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। 


এ ছাড়াও, সংশোধিত আইনে কোনও অনিয়ম চোখে পড়লে, সরকারি অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও যে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তির জন্য আসা অনুদানের টাকা আটকে দিতে পারে কেন্দ্র। বিদেশি অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি অনুদান আইনে দিল্লিতে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সদর দফতর থেকেই অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। অনুমোদনের জন্য ছাড়পত্রের অনুমোদনপত্র, আধার কার্ড, পাপোর্ট-সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক, যাতে কার কাছ থেকে টাকা আসছে এবং কোথায় তা খরচ হচ্ছে, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকে কেন্দ্রের। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে সরকার কারও অনুমোদন ৩৬০ দিন পর্যন্ত সাসপেন্ড করতে পারে, আগে যে সময়সীমা ১৮০ দিন ছিল। তাই আইন সংশোধনের পিছনে বিশেষ কিছু ধর্মীয় সংগঠনকে নিশানা করা হচ্ছ বলে অভিযোগ ওঠে।  সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে।