কলকাতা: প্রভাবশালী পরিবারে জন্ম। বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। দুঁদে রাজনীতিক, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাবা। পরে তিনি নিজেও প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিজের দেহরক্ষীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল প্রাণ। তিনি ইন্দিরা গাঁধী। স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ (Indira Gandhi Death Anniversary)।


১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর এলাহাবাদের প্রতিষ্ঠিত উকিল মোতিলাল নেহরুর পরিবারে জন্ম ইন্দিরার। বাবা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর বয়স তখন ২৮ বছর।  মা কমলা নেহরুর বয়স ১৮। বাবা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই ১৯৫৯ সালে এক বছরের জন্য কংগ্রেসের সভাপতি হন ইন্দিরা গাঁধী। মেয়েকে রাজনীতিতে এগিয়ে দিতে জওহরলালই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে সেই সময় মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু কংগ্রেসের অন্দরে সকলেই জানতেন, মেয়েকে রাজনীতিতে ঠেলতে চাননি জওহরলাল। কিন্তু কংগ্রেসিদের মতে, নেহরু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন পারস্পরিক সহাবস্থানে। তাই কেরলে নাম্বুদিরিপাদের বাম সরকারে হস্তক্ষেপ করতে চাননি। ইন্দিরাকে এনে সেই কার্যসিদ্ধি করেন কংগ্রেসেরই একাংশ। ১৯৬০ সালে কংগ্রেস সভাপতি পদে মেয়াদ শেষ হয় ইন্দিরার। জওহরলালের মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে ফের সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরেন।


ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তারপর প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা। ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি রাতে তাসখন্দে মৃত্যু হয় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর। এরপর কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে টানাপোড়েন চলে। শেষপর্যন্ত ক্ষমতায় আসেন ইন্দিরা। সেই সময় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন মোরারজি দেশাই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে তিনি এগিয়েছিলেন। ইন্দিরাকে তিনি গুরুত্ব দিতে চাননি। কিন্তু নেহরু-কন্যাই দল ও সরকারের নেতৃত্ব নিজের হাতে নেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি কে কামরাজ প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকার করেন। এরপর লড়াই শুরু হয় মোরারজি ও ইন্দিরার মধ্যে। কংগ্রেস সংসদীয় দলের ভোটাভুটিতে ইন্দিরা পান ৩৫৫টি ভোট। সেখানে মোরারজির পক্ষে যায় মাত্র ১৬৯টি ভোট। ফলে ইন্দিরাই প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৬৬ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন নেহেরু কন্যা৷ প্রথম দফায় ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন তিনি। তাঁর আমলেই দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। সংবিধানের ৩৫২ ধারা অনুযায়ী, দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরে, ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন সকাল ৮টায়, অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাধ্যমে জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত, প্রায় ২১ মাস দেশে জারি ছিল জরুরি অবস্থা।


বাংলার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল ইন্দিরার। তিনি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম রেখেছিলেন প্রিয়দর্শিনী। উচ্চশিক্ষার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নেহেরু কন্যা। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। ১৯৪২ সালে ফিরোজ গাঁধীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁর বাবার পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন ইন্দিরা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৪টি ব্যাঙ্ককে জাতীয়করণ করেন। কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ ইন্দিরার জীবনী ‘ইন্দিরা গাঁধী: আ লাইফ ইন নেচার’ বইতে উল্লেখ করেন, “ইন্দিরা গাঁধী আসলে পরিবেশপ্রেমীই ছিলেন। অন্তত নিজেকে তা-ই ভাবতেন ইন্দিরা গাঁধী। রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে কার্যতই টেনে আনা হয় তাঁকে। কিন্তু আসলে পাহাড়, পর্বত, বন-জঙ্গলই ছিল তাঁর ভালবাসা। বন্যপ্রাণ, পাখি, নুড়ি-পাথর জঙ্গলের প্রতি ছিল টান। নগরায়ন এবং শিল্পায়নে পরিবেশের ক্ষতি বলেই মনে করতেন।” 


দ্বিতীয় দফায় ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন ইন্দিরা গাঁধী। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সেবছর এমনই এক দিনে ভয়াবহ হত্যার সাক্ষী থেকেছিল দেশ। নিজের বাসভবনেই দেহরক্ষীদের হাতে খুন হন ইন্দিরা। তাঁকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়া হয়। এর মধ্যে মোট ৩০টি গুলিতে বিদ্ধ হন ইন্দিরা, যার মধ্যে ২৩টি গুলি তাঁর শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। শরীরে গেঁথে ছিল সাতটি গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা। এতটাই রক্তক্ষরণ হয় যে অস্ত্রোপচারের পরেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আজ দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর ৩৯ তম প্রয়াণ দিবস। 


আরও পড়ুন: Matangini Hazra: ইংরেজবিরোধী কর্মযজ্ঞে সামিল, বানভাসীদের 'গাঁধী বুড়ি' মাতঙ্গিনীর সংগ্রামের নানা অধ্য়ায়