নয়াদিল্লি: শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পর অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি ভারতের আর এক পড়শি দেশে। বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে নেপাল, যার আঁচ অনুভূত হচ্ছে সীমান্তের এপারেও। এখনও পর্যন্ত ২০টি তাজা প্রাণ চলে গিয়েছে। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন কে পি শর্মা ওলি। ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। (Nepal Unrest)
কিন্তু শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার দরুণ এমন পরিস্থিতি হতে পারে কী? গত কাল থেকে বার বার করে এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে উঠে আসছে। আর তাতেই এবার নয়া তত্ত্ব উঠে আসছে। আমেরিকা এবং চিনের ছায়াযুদ্ধের জেরেই নেপালের এই অবস্থা হল কি না, উঠছে প্রশ্ন। (Nepal Gen Z Protests)
সোমবার তরুণরা যখন রাস্তায়, পরিস্থিতি যখন একটু একটু করে তেতে উঠছে, সেই সময়ই বহির্শক্তির প্রভাবের তত্ত্ব উঠতে শুরু করে। কেপি সিংহ ওলির সরকার সোশ্যাল মিডিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরও পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং ‘কেপি চোর, দেশ ছোড়’-এর মতো স্লোগানে মুখর ছিল চারিদিক। এর পর শুরু হয় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, হামলার ঘটনা।
মঙ্গলবার ওলি পদত্যাগ করার পরও পরিস্থিতি থিতোয়নি। বরং রাস্তায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তরুণদের। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির দফতরে, দেশের সুপ্রিম কোর্টে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে যে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, তেমনই ব্যাপক লুঠপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা চোখে পড়ে। শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে এভাবেই তরুণদের নেতৃত্বে রাতারাতি সরকারের পতন ঘটেছিল। শ্রীলঙ্কার গোটাবায়া রাজাপক্ষ পালিয়েছিলেন মলদ্বীপে। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা পালিয়ে আসেন ভারতে। নেপালের ওলি দুবাইয়ের পথে রওনা দিয়েছেন বলে খবর মিলছে।
তাই প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার জন্য এতকিছু ঘটতে পারে কি? এমনিতেই গত কয়েক মাস ধরে নেপালের রাজনীতি তপ্ত হয়ে উঠছিল। ২০০৮ সালে নেপাল প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে সেখানে ওলি, পুষ্পকমল দহল ‘প্রচণ্ড’ এবং শের বাহাদুর দেউবার মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল দেখা গিয়েছে।
ওলি, প্রচণ্ড এবং শের বাহাদুর, তিনজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বার বার। আন্দোলন চরম আকার ধারণ করার আগে বেশ কিছু দিন ধরে নেপালে ‘Nepo Kid’ নামে ক্যাম্পেনও চলছিল। রাজনীতিকদের ছেলেমেয়েদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, মাত্রাছাড়া দুর্নীতি নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়া। চলতি বছরের শুরুতে সেখানে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিও উঠছিল।
এমনিতে ওলি বরাবরই চিনপন্থী। যে কারণে ২০২৪ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে নেপালের সুসম্পর্কেও ছেদ পড়ে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে প্রথমেই চিনে পৌঁছন তিনি। তাঁর আগে অন্য প্রধানমন্ত্রীরা যদিও ভারতকেই বেছে নিয়েছিলেন। চিন সফরে গিয়ে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড করিডর প্রকল্পেও যুক্ত হন ওলি। বিনিময়ে ঋণের দায়ে জর্জরিত নেপালকে আর্থিক সাহায্য জোগান জিনপিং। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য গড়ে তুলতে এর আগে শ্রীলঙ্কাকেও আর্থিক সাহায্য় জুগিয়েছে চিন।
চিনের সঙ্গে নেপালের এই সখ্য মনঃপুত হচ্ছিল না আমেরিকার। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প নেপালকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্য় দেওয়ার ঘোষণা করেন, যা বিদ্যুৎ এবং সড়ক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে বলে জানায় আমেরিকা। এর ফলে নেপালকে নিয়েও মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে আমেরিকা ও চিন। তাই বাংলাদেশের মতো নেপালকে নিয়েও ‘ডিপস্টেট’ তত্ত্ব উঠে আসছে। অশান্তি এমনি এমনি ঘটেনি, পরিকল্পনা মাফিক ঘটানো হয়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলেছেন ভারতীয় সেনার প্রাক্তন DGMO, লেফটেন্যান্ট জেনারেল একে চৌধরি। তাঁর কথায়, ‘নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করার পর, নেপালে এমন সরকার গঠিত হওয়া উচিত, যার দুর্নীতির পরিবর্তে দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে। নেপালে নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে আমেরিকা এবং চিনের কোনও রকম হস্তক্ষেপ দেশের নাগরিকদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমেরিকা বা চিন, কারও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা উচিত নয় পড়ুয়াদের’।