নয়াদিল্লি: দীর্ঘ সংঘাত পর্ব, বার বার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তার পরও হানাহানিতে বিরাম নেই। আবারও প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ইজরায়েল। তবে এই সংঘাত হঠাৎ করে নেমে আসেনি, বরং দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।  ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসকদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল ভারত, তার জন্য দেশভাগের চরম মূল্য চোকাতে হয়েছিল। আর ঠিক ওই বছরই পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েল বনাম প্যালেস্তাইন, দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের সূচনা হয়। (Israel-Palestine Conflict)


১৯৪৭ সালে ১৮১তম প্রস্তাবে প্যালেস্তাইনকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে। ঠিক হয়, প্যালেস্তাইনকে ভেঙে একটি ইহুদি দেশ এবং একটি আরব দেশ তৈরি করা হবে। এর পর, ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পৃথক ইজরায়েল রাষ্ট্রের গঠন হয়। আর তার সঙ্গেই আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সূচনা ঘটে। ১৯৪৯ সালে ইজরায়েলের জয়ের মাধ্যমে সেই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। সেই যুদ্ধে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার প্যালেস্তিনীয় ঘরছাড়া হন। এর পর ওই অঞ্চল তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, পৃথক রাষ্ট্র ইজরায়েল, জর্ডান নদীর তীরের ওয়েস্ট ব্য়াঙ্ক, এবং গাজা। (Israel-Palestine War)


এর পর যত সময় এগিয়েছে, সংঘাত ক্রমশ বেড়েছে, বিশেষ করে ইজরায়েল এবং মিশরের মধ্যে, জর্ডান এবং সিরিয়ার মধ্যে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সঙ্কটের সময় সিনাই উপদ্বীপ আক্রমণ করে ইজরায়েল। তাতে একজোট হয় মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়া। পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে তারা। ১৯৬৭ সালে মিশর এবং সিরীয় বায়ুসেনার উপর হামলা চালায় ইজরায়েল। সেই যুদ্ধ চলে ছ'দিন ধরে। ওই যুদ্ধের পরই সিনাই উপদ্বীপ এবং মিশরের থেকে গাজার উপর আধিপত্য কায়েম করে ইজরায়েল। জর্ডানের থেকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্ব জেরুসালেম ছিনিয়ে তারা। সিরিয়ার থেকে ছিনিয়ে নেয় গোলান হাইটস। 


এর ছ'বছর পর হৃত অঞ্চল উদ্ধার করতে মিশর এবং সিরিয়া ইজরায়েলকে দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। ওই যুদ্ধে কোনও পক্ষই তেমন লাভবান হয়নি। কিন্তু ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেদের জয়ী ঘোষণা করেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল-সাদাত। তার জেরে ইজরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা হয় মিশর এবং সিরিয়ার। দীর্ঘ ৩০ বছর পর, ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ইজরায়েলেপ মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি ঘটলেও প্যালেস্তিনিয়া কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে গলায়। 


আরও পড়ুন: Israel-Palestine War: আরও এক যুদ্ধের সূচনা, ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট নিক্ষেপ, ফের মুখোমুখি ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন


ভাগাভাগির পর থেকে, বরাবরই প্যালেস্তিনীয়রা স্বশাসন শাসন কায়েমের পক্ষে ছিলেন। ১৮৮৭ সালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে এবং গাজায় বসবাসকারী হাজার হাজার প্য়ালেস্তিনীয় নাগরিক ইজরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৯৯৩ সালে প্রথম ওসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজায় প্যালেস্তিনীয়দের স্বশাসনের দাবি স্বীকৃতি পায়। নবগঠিত প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষ এবং ইজরায়েল সরকার পরস্পরের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নিতে সম্মত হন। এর পর, ১৯৯৫ ,সালে দ্বিতীয় ওসলো চুক্তিতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ছয়টি নগর এবং ৪৫০টি শহর থেকে ইজরায়েলকে সরে যেতে হবে বলে প্রস্তাব যুক্ত হয়।  সেই সময় ইজরায়েল তাতে সম্মত হয় বলেও জানা যায়। 


কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দখল ছাড়েনি বলে লাগাতার অভিযোগ উঠে আসতে শুরু করে। তার জেরে ২০০০ সালে ইজরায়েল বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করে। ইজরায়েলের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের তৃতীয় পবিত্র স্থান, আল-আকসা মসজিদে পা রাখলে, দলে দলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শামিল হন সকলে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে বিদ্রোহ শুরু হয়, ২০০৫ সাল পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়। ২০০২ সালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বরাবর দেওয়াল তোলায় অনুমোদন দেয় ইজরায়েল সরকার, যার বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও।


২০১৩ সালে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে শান্তিস্থাপন করিয়ে দিতে উদ্যোগী হয় আমেরিকা। কিন্তু মাঝপথেই সেই শান্তিপ্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। কারণ শান্তিচুক্তির বৈঠক চলাকালীনই, ২০১৪ সালে প্যালিস্তাইনের তদানীন্তন শাসকদল 'ফতেহ' প্রতিদ্বন্দ্বী 'হামাস' দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোট সরকারের ঘোষণা করে।  মিশরের 'মুসলিম ব্রাদারহুড' সংগঠনের শাখা 'হামাস'। প্যালেস্তিনিয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিরাজ করলেও, 'হামাস'কে ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন বলে ঘোষণা করে আমেরিকা। প্য়ালেস্তিনিয়ায় সেই 'হামাস' সংগঠনের সরকারে আসা মনঃপুত হয়নি আমেরিকার। ফলে মাঝপথে ভেস্তে যায় শান্তি আলোচনা। আবারও ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে সংঘাত চরম আকার ধারণ করে। 


এর পর, ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইজরায়েলি বাহিনী এবং 'হামাস' সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় শুরু হয়। তাতে ইজরায়েলের উদ্দেশে প্রায় ৩০০০ রকেট ছোড়ে 'হামাস'। এর পাল্টা, ইজরায়েলি আক্রমণে কার্যতই ধুলোয় মিশে যায় গাজা। সে বছর অগাস্ট মাসে দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তত দিনে ৭৩ জন ইজরায়েলি নাগরিক এবং ২২৫১ জন প্যালেস্তিনীয় নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এর পর ২০১৮ সালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলাকালীন ১৮০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ৬০০০-এর বেশি মানুষ।


২০১৮ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে বৈদেশিক নীতি চুক্তি স্থাপনে অগ্রণী হন। কিন্তু গোড়াতেই প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের ত্রাণের জোগান দেওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের তহবিলে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় আমেরিকা। তেল আভিভ থেকে আমেরিকার দূতাবাস সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জেরুসালেমে, তাতে ইজরায়েল খুশই হলেও, প্যালেস্তাইন এবং পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলি আমেরিকার সমালোচনায় সরব হয়। কারণ ইজরায়েল গোটা জেরুসালেমকে নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে। প্যালেস্তিনীয়রা আবার ভবিষ্যতের প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুসালেমের উপর দাবি জানান। এর পর আমেরিকার শান্তি প্রস্তাবে ওয়েস্ট ব্য়াঙ্ক এবং অবিভক্ত জেরুসালেমের উপর ইজরায়েলি কর্তৃত্ব কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হলে, সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্যালেস্তাইন।  


২০২০ সালের অগাস্ট মাসে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং বাহরাইন বিষয়টি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে এগোয়। তাতে শামিল হয় আমেরিকা-সহ পশ্চিম এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ। অ্যাব্রাহাম চুক্তির প্রস্তাবও আনা হয়, কিন্তু প্যালেস্তাইন তাতে রাজি হয়নি। সে বছর অক্টোবরে ইজরায়েলের আদালত পূর্ব জেরুসালেম থেকে বেশ কিছু প্যালেস্তিনীয় পরিবারকে উৎখাতের নির্দেশ দেয়। তাঁদের জমাজমা, সম্পত্তি তুলে দিতে বলা হয় ইহুদিদের হাতে।  তারও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০২১ সালে এপ্রিল মাসে জেরুসালেমের রাস্তায় আন্দোলনে নামেন প্যালেস্তিনীয়রা। শেখ জারা থেকে ইজরায়েলিদের সরানোর দাবিতে রাতের পর রাত ধরে চলে ধর্না। মে মাসে তাতে সিলমোহর দেয় আদালত। সেই নিয়েও অশান্তি শুরু হয়। সেই সময় আল-আকসা মসজিদ চত্বরে পুলিশের বিরুদ্ধে গুলি, গ্রেনেড এবং ছররা বন্দুক থেকে রবারের বুলেট ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। শয়ে শয়ে প্যালেস্তিনীয় নাগরিক আহত হন তাতে।


শীঘ্রই অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও। দ্রুত তা সামরিক লড়াইয়ে পরিণত হয়। গোলাগুলি, বোমাবাজি, রকেট হামলার ঘটনা সামনে আসে। তাতে ২০ জন প্যালেস্তিনীয়র মৃত্যু হয়। আকাশপথে ইজরায়েল হামলা চালায়, বসতি এলাকা, এমনকি শরণার্থী শিবিরেও বোমা ফেলা হয় বলে অভিযোগ সামনে আসে। ২০২১ সালের মে মাসে ইজরায়েল এবং 'হামাস' অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়। দুই পক্ষই বিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। তাতে প্রায় ৩০০ প্যালেস্তিনীয় মারা যান। আহত হন প্রায় ২০০০ মানুষ। ১১ দিনের লড়াইয়ে মারা যান ১৩ জন ইজরায়েলি নাগরিক। ওই লড়াইয়ে গাজায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানায়, প্রায় ৭২, ০০০ প্যালেস্তিনীয় নাগরিক গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।  তার পরই কয়েক সপ্তাহ আগে গাজা সীমানা বন্ধ রাখা নিয়ে লডডাি শুরু হয়। তার পরই যুদ্ধের ঘোষণা।