সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: পণ্ডিতেরা বলেন, মা কালীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋকবেদের দেবীসূক্তে। শাক্তরা ঈশ্বরকে যে প্রকৃতি ও পুরুষ রূপে কল্পনা করেন, সেই প্রকৃতিই কালী। যিনি সৃষ্টি করেন, বিনাশও করেন। নারীসত্ত্বা বা দেবীসত্ত্বাকে কেন্দ্র করে যে একাধিক ধর্ম গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল দেবীভাগবত পুরাণ, যা শাক্তদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। মহাবিদ্যা শব্দকে বিশ্লেষণ করলে পাই মহা’ অর্থাৎ মহান, ‘বিদ্যা’ অর্থাৎ রূপ বা প্রকাশ। ‘মহাবিদ্যা’ অর্থাৎ বিশেষ রূপ বা প্রকাশ। নারায়ণের দশ অবতার যেমন সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ে বিষ্ণুর আত্মপ্রকাশ তেমনই শক্তির দশটি রূপের প্রত্যেকটিই নারায়ণের ওই অবতারগুলির নারীরূপ।


শক্তির এই দশ মহাবিদ্যা রূপ ধারণের পিছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী। শিব ও সতীর বিবাহে মত ছিল না দক্ষ রাজার। তিনি শিবকে অপমান করার জন্য এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে সমস্ত দেবতাদের আমন্ত্রণ করা হলেও ডাক পেলেন না শিব ও সতী। এদিকে নারদের মুখে সেই বৃহৎ যজ্ঞের আয়োজনের কথা শুনে সতী বাপের বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরলেন। কিন্তু শিবও নাছোড়। তিনি বিনা আমন্ত্রণে সতীকে বাপের বাড়ি যেতে দেবেন না, কারণ তিনি জানেন সেখানে গেলে দক্ষরাজা কটুকথা শোনাবেন যাতে সতী অপমানিত হবেন। সতী যখন দেখলেন শিব কিছুতেই তাঁকে যেতে দিতে রাজি নন তখন তিনি তৃতীয় নয়ন থেকে আগুন বের করে কালী রূপ ধারণ করলেন। এই হল প্রথম মহাবিদ্যা। সতীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে শিব এক একবার এক একদিকে পালাতে লাগলেন আর সতী প্রতিবার নতুনরূপে শিবকে ভয় দেখিয়ে বাপের বাড়ী যাবার অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করলেন। এইভাবে সতী একে একে দশটি রূপে নিজের রূপের প্রকাশ মেলে ধরলেন শিবের কাছে। অবশেষে শিবের অনুমতি পাওয়া গেল। সতীর এই দশটি রূপই হল দশমহাবিদ্যা।

কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।

বগলা সিদ্ধ বিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।

এতা: দশমহাবিদ্যা: সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্ত্তীতা:।

কালী প্রথম মহাবিদ্যা

‘কালী’ অর্থাৎ যিনি কালকে হরণ করেছেন। দেবী কালিকা চতুর্ভুজা, বাম হাতের উপরে খড়্গ, নীচের হাতে মুণ্ড। ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা। দিগম্বরী দেবীর গলায় মুণ্ডমালা। শবরূপী শিবের উপর বিপরীত রতাতুরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। ডান পা আগে এবং বাম পা পিছনে থাকলে তাঁকে দক্ষিণা কালী বলে। বাম পা সামনে এবং ডান পা পিছনে থাকলে তাঁকে বামা কালী বলে।

তারা দ্বিতীয় মহাবিদ্যা

শবরূপী শিবের হৃদয়ের দাঁড়িয়ে দেবী। ডান পা সামনে, বাম পা কিছুটা পিছনে। চতুর্ভুজা দেবীর হাতে খড়্গ, নীল পদ্ম, কর্তৃকা ও খর্পর। দেবী খর্বাকৃতি, লম্বোদর, নীলবর্ণ। তিনি বাঘ ছাল পরিহিতা। মাথায় জটা, সেখানে সাপের অধিষ্ঠান। দেবীর তিনটি রূপ- তারা, একজটা এবং নীল সরস্বতী।

ষোড়শী তৃতীয় মহাবিদ্যা

ইনি ত্রিপুরসুন্দরী বা ললিতা নামেও প্রসিদ্ধ। পূর্ণতার প্রতীক তিনি। কৃষ্ণবর্ণ, শিবের উপর উপবিষ্টা, ষোড়শবর্ষীয়া বালিকা। চতুর্ভূজা দেবীর দুই হাতে তীরধনুক। সূর্যের মত গায়ের রং। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র ও ইন্দ্রের মাথার ওপর তাঁকে কল্পনা করা হয়। তিনি সর্বসৌভাগ্যদায়িনী।

ভুবনেশ্বরী চতুর্থ মহাবিদ্যা

মহাদেবের লীলা সহচরী দেবী ভুবনেশ্বরী। বিশ্বের সমস্ত খারাপকে ধ্বংস করেন। রক্তবর্ণা দেবী সদাহাস্যময়ী। চতুর্ভুজা দেবীর একহাতে অঙ্কুশ, অন্য হাতে পাশ। বাকি দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা। দুর্গম অসুরের হাত থেকে তিনি দেবতাদের রক্ষা করেন তাই তাঁর আরেক নাম দুর্গা। আবার হাতে ধরা শাক ও ফলমূলে প্রাণীকুল রক্ষা করেন বলে দেবীর আরেক নাম শাকম্ভরী।

ভৈরবী পঞ্চম মহাবিদ্যা

সহস্র সূর্যের মতো উজ্জ্বল তাম্রবর্ণা দেবীর মাথায় জটা এবং কপালে শোভিত চন্দ্রকলা। রক্তবস্ত্র পরিহিতা, গলায় মুণ্ডমালা। বাম হাতে পুস্তক ও অভয় মুদ্রা। ডান হাতে বর মুদ্রা ও জপমালা। নৃসিংহের অভিন্ন শক্তি ত্রিপুরা ভৈরবী।

ছিন্নমস্তা ষষ্ঠ মহাবিদ্যা

দ্বিভুজা দেবী দিগম্বরী। বাম হাতে নিজের কাটা মুণ্ড। ডান হাতে খর্পর। গলায় মুণ্ডমালা কাটা গলা থেকে নির্গত তিনটি রক্ত ধারার একটি দেবী নিজেই পান করছেন, অপর দুটি ধারা পান করছেন তাঁর দুই সহচরী। বিপরীত ভাবে রতিতে আসক্ত কামদেব ও রতির উপর দণ্ডায়মান। এই ভয়াল রূপ ধারণের পিছনে একটা গল্প আছে। দেবী ভবানী তাঁর দুই সহচরী জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে মন্দাকিনীতে স্থান করতে গেছেন। স্নান সেরে উঠে দেবী ক্ষুধায় কাতর হলেন। তাঁর দুই সহচরীও ক্ষুধায় কাতর হয়ে তাঁর কাছে খাবার প্রার্থনা করলেন। দেবী অপেক্ষা করতে বলায় তাঁরা শিশুর মতো বায়না করতে লাগলেন। এবার দেবী নিজের খড়্গ দিয়ে নিজের মুণ্ড কেটে ফেললেন। মুণ্ড রইল তাঁর বাম হাতে ধরা। দুটি রক্তধারা পান করতে লাগলেন দুই সহচরী। তৃতীয় ধারাটি তিনি নিজেই পান করলেন। কোন সাধারণ গৃহস্থ দেবী ছিন্নমস্তার পুজো করেন না। শুধুমাত্র সাধক ও উপাসকরাই সিদ্ধি লাভের জন্য এঁর সাধনা করেন।

ধূমাবতী সপ্তম মহাবিদ্যা

ধূমাবতী বিধবা রূপধারিনী দেবী। তিনি কাকধ্বজ রথে চড়ে রয়েছেন। তাঁর গায়ের রং বিবর্ণ, পরণে মলিনবসন। এক হাতে কুলো, অন্য হাতে বর মুদ্রা। তিনি দুর্ভিক্ষ, অভাব, সংকটের দেবী। ধূমাবতীর এমন রূপ ধারণের পিছনে রয়েছে এক কাহিনী। একবার পার্বতী ক্ষুধিত হয়ে মহাদেবের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু সেই সময় শিব পার্বতীকে খাবার দিতে অসমর্থ হওয়ায় ক্ষুধায় কাতর হয়ে পার্বতী সামনে মহাদেবকেই গ্রাস করে ফেললেন। এবার পার্বতীর দেহ থেকে ধোঁয়া বার হতে লাগলো। মহাদেব এবার মায়ার শরীর ধারণ করে বললেন দেবী তুমি আমাকে গ্রাস করেছো তাই তুমি বিধবা হয়েছ। তুমি বৈধব্য বেশেই পূজিত হবে। পার্বতী যখন দক্ষ যজ্ঞের আগুনে নিজেকে সঁপে দিলেন তখন সেই আগুন থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হল তাতেই দেবী ধূমাবতী প্রকট হলেন।

বগলা অষ্টম মহাবিদ্যা

রত্ন সিংহাসনে আসীন দেবী বগলামুখী পীতবর্ণ, পীতবসনা। দ্বিভুজা দেবীর এক হাতে মুদ্গর অপর হাতে ধরা শত্রুর জিহ্বা। তবে কোথাও কোথাও চতুর্ভুজা দেখা যায়। বগলামুখী দেবীর আবির্ভাবের পিছনেও এক কাহিনী রয়েছে। একবার সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে প্রবল ঝড় উঠলো। তখন সৌরাষ্ট্র দেশে হরিদ্রা সরোবরের তীরে বিষ্ণু ভগবতীর তপস্যা করলেন। মঙ্গলবার চতুর্দশীর মধ্যরাত্রে বগলামুখী রূপে দেবী আবির্ভূত হয়ে বিষ্ণুর সঙ্গে মিলিত হলেন। তাঁর আবির্ভাবে প্রলয় শান্ত হয়ে সৃষ্টি রক্ষা পেল এবং দেবী বৈষ্ণবী হলেন।

মাতঙ্গী নবম মহাবিদ্যা

মাতঙ্গী দেবী সর্বসিদ্ধিদায়িনী। শ্যাম বর্ণ, অর্ধচন্দ্র ধারিণী, চতুর্ভুজা দেবীর হাতে থাকে খড়গ, পাশ ও অঙ্কুশ। তাঁর গায়ের রং নীল। তিনি রক্তবস্ত্র পরে রত্ন সিংহাসনে বসে বীণা বাজাচ্ছেন। মাতঙ্গী পূর্ণতা তথা সরস্বতীর মূর্তি।

কমলা দশমহাবিদ্যা

কমলা শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী। তিনি লক্ষ্মী রূপে বিষ্ণুকে পতিরূপে বরণ করেছেন। দ্বিভুজা থেকে অষ্টভুজা পর্যন্ত কমলা রূপ পাওয়া যায়। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের ফলস্বরূপ তাঁর আবির্ভাব। তিনি পদ্মাসনা স্বর্ণবর্ণা। সাধারণত দুই হাতে দুটি পদ্ম, বাকি দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা। সোনার কলসে অমৃতজলে দেবীকে অভিষেক করাচ্ছে শ্বেতহস্তী। হাতি আসলে বৈভবের সূচক। তাই দেবী সমৃদ্ধি, সম্পদ, উর্বরতা ও সৌভাগ্যদায়িনী।