ওয়াশিংটন: অনেকটা দেরিতেই মাঠে নেমেছিলেন। ভাল সাড়াও পেয়েছিলেন সব মহল থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশা ধরে রাখতে পারলেন না আমেরিকার বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী কমলা হ্যারিস। প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জয়ী হতে পারলেন না তিনি। ফলে আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট, ভারতীয়-আফ্রিকান বংশোদ্ভূত প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাস রচনা করা হল না তাঁর। (Kamala Harris)


এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের তরফে জো বাইডেনকেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হয় শুরুতে। কিন্তু বাইডেনের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ ধরা পড়ে সব মহলেই। শেষ পর্যন্ত, নির্বাচনের মাস তিনেক আগে সরে দাঁড়ান জো। নিজের জায়গায় কমলাকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে এগিয়ে দেন তিনি। কমলার সঙ্গে ট্রাম্প পেরে উঠবেন না বলে গোড়ার দিকে প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ছবিটা বদলাতে শুরু করে। বুধবার ফলাফল ঘোষণার পর কমলার পরাজয়ের কার্যকারণ হিসেবে একাধিক তত্ত্ব উঠে আসছে। (US Presidential Elections 2024)


কমলার পরাজয়ের নেপথ্যে প্রথম কারণ হিসেবে উঠে আসছে তাঁর পরিচয়। অভিবাসী পরিবারের সন্তান কমলা। মনে-প্রাণে তিনি নিজেকে আমেরিকান হলেও, দেশের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের আমেরিকার নির্বাচনে যে গভীর মেরুকরণ চোখে পড়েছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, অভিবাসী বিদ্বেষ, তীব্র জাতীয়তাবাদকে ট্রাম্প লাগাতার খোরাক জুগিয়ে গিয়েছেন। তার সামনে ফিকে হয়ে গিয়েছে কমলার সাবধানী অবস্থান।



বারাক ওবামা যখন নির্বাচনী লড়াইয়ে নাম লিখিয়েছিলেন, সেই সময় নিজের কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়কেই হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। কিন্তু কমলা নিজের ভারতীয়-কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়কে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। নিজেকে আমেরিকান, দেশের মানুষের ঘরের লোক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি, যা মানুষ একেবারেই গ্রহণ করেননি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ২৫০ বছর পরও আমেরিকায় আজ পর্যন্ত কোনও মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে একজন মহিলার কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ায় যে অনীহা রয়েছে আমেরিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, কমলার পরাজয়ের নেপথ্যে তাও কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই Aljazeera-য় বস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ট্যামি বিজিল জানান, কমলার পরাজয়ই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, লিঙ্গ এবং জাতি বৈষম্য ঘোচাতে আরও অনেক দূর যেতে হবে আমেরিকাকে। 


জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির নারী এবং লিঙ্গসাম্য বিভাগের ডিরেক্টর নাদিয়া ব্রাউনও একই মত পোষণ করেন। তাঁর যুক্তি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার কমলার চেয়ে যোগ্য প্রার্থী আর কেউ ছিলেন না। দীর্ঘ কয়েক দশক সরকারি কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। তার পরও মানুষ ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছেন, যার নেপথ্যে রয়েছ গভীরে নিহিত জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ। কমলাকে লাগাতার 'নির্বোধ', 'মানসিক ভারসাম্যহীন', 'মূর্খ' বলে আক্রমণ করেছেন ট্রাম্প। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে ভোটারদের একাংশের মানসিকতা মিলে গিয়েছে বলে মত নাদিয়ার। ওবামাকেও কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া নিয়ে, ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তিনি পুরুষ বলে পরীক্ষায় উতরে যান, যা কমলা এবং তাঁর পূর্বসূরি হিলারি ক্লিন্টনের ক্ষেত্রে ঘটেনি বলে মত তাঁর।


পশ্চিম এশিয়া নিয়ে কমলার অবস্থানের জেরে ডেমোক্র্যাটদের বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্কও এবার তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েল বনাম হামাসের যুদ্ধে জো বাইডেন সরকারের অবস্থান নিয়ে গোড়া থেকেই প্রশ্ন তুলছেন সেখানে বসবাসকারী অভিবাসীরা।  এমনকি ইজরায়েল লেবাননে হামলা চালানোর পরও যেভাবে বাইডেন এবং কমলা ইজরায়েলর প্রতি সমর্থনে অনড় থেকেছেন, তাতে আরব-আমেরিকান, মুসলিম ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।  নির্বাচনের আগেই এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ডেমোক্র্যাটদের সতর্ক করা হয়। তাতে কর্ণপাত না করার মাশুলও কমলাকে গুনতে হল বলে মত অনেকের।


ডেমোক্র্যাটদের অনেকে আবার বলছেন, বাইডেনের বিকল্প হিসেবে নিজেকে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারেননি কমলা। বাইডেনের প্রতি কোথাও আনুগত্য কাজ করেছে তাঁর, যে কারণে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বিদেশনীতি থেকে সরে এসে, নতুন কিছু করে দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। মুখে পরিবর্তনের কথা বললেও, নিজেকে গণ্ডিতে আটকে রেখেছিলেন। তাই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়নি ভোটারদের মধ্যে।


ট্রাম্পকে হারিয়ে মসনদ দখলের লড়াইয়ে কমলা ট্রাম্পকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন বলেও মনে করছেন অনেকে। ট্রাম্প গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক, প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নয় বলেই বেশি প্রচার করেছেন। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে কী কী বিপদ ঘটতে পারে, তা তুলে ধরেছেন। নিজে ক্ষমতায় এলে মানুষের জন্য কী করবেন, তা নিয়ে সেভাবে মুখ খোলেননি কমলা। 


কমলার হারে প্রশ্নের মুখে ডেমোক্র্যাটরাও। তাদের প্রার্থী চয়নের ক্ষমতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরে কমলাকে নিয়ে তেমন উৎসাহ চোখে পড়েনি কোথাও। তার পরও তিন মাস আগে কমলাকে বেছে নেওয়া হল কেন,  উঠছে প্রশ্ন। এমনকি বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে রেখে দিলেও, অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে তুলনামূলক ভাল সাড়া পাওয়া যেত বলে মনে করছেন দলেরই অনেকে।