কলকাতা : এই পল্লিতে প্রতিদিন হাজার-হাজার মানুষের যাতায়াত। কেউ বা এখানকার চেনা মুখ। কেউ বা হঠাতই এসে পড়া। শহরের এই অংশে রাত বাড়ে, কিন্তু আলো নেভে না। অর্থনীতির হাজারো ওঠাপড়াতেও মন্দার মুখ দেখেননি এখানকার মানুষ। এই প্রথম। 
এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ যৌনপল্লি সোনাগাছি । নিয়ম অনুসারে, বারাঙ্গনাদের দুয়ারের মাটি ছাড়া মা দুগ্গার পুজো হয় না। কিন্তু ওই টুকুই। সমাজের কাছে এঁরা ব্রাত্য। লোকসমক্ষে এঁরা পাপবিদ্ধা। শুধু এঁরা নন, এঁদের সন্তানদেরও মেনে নিতে পারেন না সমাজের অনেকেই। তবু এঁরা বেড়ে ওঠে মায়েদের বৃত্তির উপর নির্ভর করেই। ২০২০ সালে করোনা-হানার পর থেকে  ভয়ঙ্কর সঙ্কটে এই শিশুরা। 
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'দুর্বার' - র অ্যাডভোকেসি অফিসার মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় জানালেন, শুধুমাত্র সোনাগাছিতেই প্রায় ৭ হাজার জনের বাস। এছাড়াও কলকাতার আশেপাশে থেকে প্রায় ৩ হাজার মেয়ে এই অঞ্চলে আসেন জীবিকা নির্বাহের জন্য । অর্থাত্ প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের সরাসরি পেটের যোগান দেয় এই যৌনপল্লি।
শুধু তাই নয় এঁদের উপর নির্ভর করে অনেক সংসার , অনেকগুলি শিশুর পেট । 
করোনাভাইরাস নামক ত্রাস যে সরাসরি তাঁদের জীবনকে বদলে দেবে ভাবতে পারেনি এই এলাকার মানুষগুলো ।  যত বড় অর্থনৈতিক ঝড় আসুক না কেন কিংবা টালমাটাল পরিস্থিতি সোনাগাছির জীবনকে চট করে থমকে দিতে পারেনি, ব্যতিক্রম হল করোনাভাইরাস ।  মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় জানালেন, গত বছর থেকেই বহু মানুষের দু'বেলা, দু'মুঠো অন্ন জোগাড় করা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে  দেহপসারীদের কাছে। যদিও বা ত্রাণের চালে-ডালে তাঁদের পেট চলে, দুর্ভোগের শেষ নেই এ অঞ্চলের শিশুদের। জানালেন, সমাজকর্মী রতন, যিনি এক যৌনকর্মীরই সন্তান।
দুর্বারের তরফে জানানো হল, সোনাগাছিতে যৌন কর্মীদের মধ্যে অনেকগুলো ভাগ রয়েছে । এঁদের মধ্যে কারও কারও আয় এতটাই যারা যে, মাসে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঘর ভাড়া দেন তাঁরা। তাঁদের উপর নির্ভর করে গ্রামগঞ্জে পরিবার জীবন যাপন করে। তাঁরাও এখন মানুষের দানের উপর নির্ভরশীল । সম্প্রতি যৌনকর্মীদের দিকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন টলিউডের তারকা-দম্পতি মানালি দে এবং অভিমন্যু মুখোপাধ্যায় । বিশ্ব যৌনকর্মী দিবসে অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় আবেদন করেন, 'করোনা পরিস্থিতিতে কষ্টের মধ্যে রয়েছে এমন মানুষের কথাই যদি বলতে চান.. তাহলে যৌনকর্মীদের কথা বলুন' । এছাড়াও হালফিলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গৌরি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এলাকায় সাহায্য নিয়ে পৌঁছে যান বেশ কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী। ছিলেন অভিনেত্রী দেবযানী চ্যাটার্জি, পূজারিনী ঘোষ, অন্তশীলা ঘোষ প্রমুখ। 




' যাঁদের রোজগার কিছু বেশি, তাঁদের তো কিছু পুঁজি রয়েছে । কিন্তু যাঁদের আয় কম,তাঁদের ঘরে এখন প্রদীপের তেলটুকু দেওয়ারও আয় নেই। ' মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় জানালেন, দুর্বার-এর হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন সোনাগাছিতে প্রায় ২১ হাজার ক্রেতার আনাগোনা ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেই সংখ্যাটা এক ধাক্কায় ৩ থেকে ৪ শয়ে নেমে আসে। আর এখন ক্রেতা প্রায় নেই। এর উপর সমস্যা ভ্যাক্সিনেশন। সোনাগাছির যৌনকর্মী মায়ের সন্তান রতন জানালেন, 'অনেকেই হয়তো এই পরিস্থিতিতে একদিন কিছু চালডাল খাবার নিয়ে হাজির হচ্ছেন, কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করে তাঁদের থেকে দান গ্রহণ করছেন। কিন্তু অনেকেই ভাবছেন না, এঁদের সন্তানদের কথা কীভাবে চলবে ! এই বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ একপ্রকার অন্ধকারেই । 
সমাজকর্মী রতন জানালেন এখনও পর্যন্ত সেইভাবে যৌনকর্মীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়নি । তবে কথা চলছে, খুব শিগগিরই তাঁদের সংস্থার সঙ্গে নথিভূক্ত যৌনকর্মীদের টিকাকরণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি । সচেতনতার অভাব রন্ধে রন্ধে । সাত-পাঁচ ভেবে টিকাকরণের অনীহা যৌনপল্লির অনেকেরই । তাই দুর্বার এর পক্ষ থেকে সকলকে সচেতন করে তোলার ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে বিভিন্ন যৌনপল্লীতে এককালীন ৫ কেজি করে চাল আলু দেওয়া হয়েছে।  পেট চালাতে কেউ কেউ বিক্রি করছেন শাকসবজি । সামান্য কিছু জন হাত লাগিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে স্যানিটাইজার, মাস্ক, স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরিতে। 
দুর্বারের পক্ষ থেকে জানানো হলো করোনা বিধি কঠোরভাবে মেনে এখানে কাজ চলছিল। ক্রেতাদের আপাদমস্তক স্যানিটাইজেশন করে  প্রবেশ করতে হত যৌনকর্মীর বাড়িতে।  একজন ক্রেতা চলে যাওয়ার পরই পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা এবং সর্বত্র স্যানিটাইজ করা হত।  কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর আর বড় একটা কেউ সাহস করে এ পল্লিতে আসেন না।
দুর্বার সংস্থার অন্যতম কর্মী রতন এবিপি লাইভ এর মাধ্যমে সকলের কাছে আবেদন রাখলেন, যৌনকর্মীদের জন্য অনেকেই এগিয়ে আসছেন । এককালীন চালডাল দিয়ে সাহায্য করছেন । অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন । আর্থিক সাহায্য আসছে বিভিন্ন  ক্লাবের তরফেও । কিন্তু এবার যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য কিছু ভাবা হোক । এখানেও যে নিষ্পাপ ফুটফুটে অনেকগুলি শিশুর বাস । সেটা যেন সমাজ না ভুলে যায় । অতিমারি পরিস্থিতিতে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও রয়েছে।