ঋত্বিক মণ্ডল, কলকাতা: তালিবানের আক্রোশে আফগানিস্তানের গজনি গেটের ধুলোয় মিশে যাওয়ার এই ছবি, মনে করিয়ে দিয়েছে ২০ বছর আগের আরেক ধ্বংসের ছবিকে। সময়টা ২০০১-এর মার্চ মাস। তালিবান অধ্যুষিত আফগানিস্তানে নির্মম ভাবে ধ্বংস করা হল প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তি। ভয়ঙ্কর ভাবে। ভারতের স্মৃতিতে যা এখনও টাটকা দগদগে ঘায়ের মতোই। আফগানিস্তানের বামিয়ানে তথাগতর মূর্তিকে প্রাক্তন তালিবান প্রধান এবং প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের নির্দেশে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিল তালিবান জঙ্গিরা। বিশ্বে আর যেকটি বড় বুদ্ধ মূর্তি আছে, তার মধ্যে বামিয়ানের দুটি ছিল যথেষ্ট বিখ্যাত ও বৃহত্। এই বুদ্ধমূর্তি দুটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। বড় মূর্তিটির উচ্চতা ছিল ৫৫ মিটার। ছোটটির উচ্চতা ৩৫ মিটার।
ইতিহাসবিদরা বলেন, গান্ধার শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন, পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে বানানো এই মূর্তিদুটির বয়স হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছরের বেশি! প্রাচীন এই শিল্পকলাকে নির্মম ভাবে ধ্বংস করতে হাত কাঁপেনি তালিবানের। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে কোনও মূর্তির প্রতিই তালিবানদের ঘৃণা। কোনও প্রকার মূর্তিতে অবিশ্বাসী তালিবানি জঙ্গিরা সেদিন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মূর্তিদুটিকে। শিউরে উঠেছিল বিশ্ব। অহিংসার প্রতিভূ তথাগতর মূর্তির প্রতি এই ভয়ানক রাগ দেখে।
তারা আবার এসেছে ফিরে। ঠিক দুইটি দশক পর। ২০ বছর পর ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতার রাশ আবার তালিবানের হাতে! আবারও শুরু ত্রাসের রাজত্ব। তবে কি আবার তালিবানি সন্ত্রাসের শিকার হবে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন? বুদ্ধমূর্তির পর এবার প্রত্নতাত্ত্বিকদের উদ্বেগ বুদ্ধদেবের দান পাত্র নিয়ে। বর্তমানে যেটি রাখা রয়েছে, কাবুলের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।
সেই ২০১৩ সালে মনমোহন সিংহের সময় থেকেই বুদ্ধদেবের এই দানপাত্রটিকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত সরকার। বুদ্ধদেবের এই দানপাত্রের উচ্চতা ৮৬ সেন্টিমিটার। পরিধি ৩৬ সেন্টিমিটার। সম্পূর্ণ স্যান্ডস্টোন বা বেলেপাথরের তৈরি এই বাটিটির ওজন ১৯৬ কেজি। ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে তত্কালীন বিহারের বৈশালীতে এই দানপাত্রটি তৈরি হয়েছিল। বুদ্ধের শিষ্যরা এই দানপাত্র মাথায় করে নিয়ে শহরের রাস্তায় ভিক্ষে করতে বেরোতেন। এমনকি একাধিকবার স্বয়ং বুদ্ধদেবের স্পর্শও পড়েছে এই দানপাত্রে।
গজনি শহরে এখন তাণ্ডব চালাচ্ছে তালিবান। ধ্বংস করছে একে একে সবকিছু। আতঙ্কে আফগানিস্তান। আবারও একবার আশঙ্কার মেঘ গজনি শহর স্থিত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি নিয়ে। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, গজনি গেট---তালিবানের হাতে ধ্বংস হওয়ার পর এখন চিন্তা বুদ্ধের দানপাত্র নিয়ে।
কী করে কাবুলে গেল এই দানপাত্রটি? শোনা যায়, কণিষ্কের রাজত্বকালে বৌদ্ধদের সপ্তম সম্মেলন হয়েছিল পেশোয়ারে। তখনই বুদ্ধদেবের যে কোনও একটি স্মারক সেখানে রাখার দাবি ওঠে। সেইমতো হাতি, লোকলস্কর দিয়ে সেই বাটি পাঠাবো হয় সেখানে। পরিব্রাজক ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং-এর লেখাতেও এর উল্লেখ রয়েছে। এমনকী অজন্তা-ইলোরার গুহাতেও এই দানপাত্র নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শেষ দিকে বুদ্ধদেবের এই দানপাত্রটি দেশে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু হয়। সেইসময় ২০১৩ সালে ২০ দিনের জন্য কাবুলে গিয়েছিলেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ইস্টার্ন জোনের প্রাক্তন রিজিওনাল ডিরেক্টর। এরকম একাধিক জিনিস তাঁর নজরে আসে, যা নিয়ে অনুমান করা যায় যে এই বাটিটি ভারতেই বানানো হয়েছিল। কাবুল থেকে ফিরে বিদেশমন্ত্রকে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন তাঁরা। তারপর দানপাত্রটি এদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অনেকদূর এগিয়েওছিল বর্তমান সরকার। কিন্তু তার আগেই ফের তালিবান গ্রাসে চলে গিয়েছে দেশের সিংহভাগ অংশ। এখন চিন্তা একটাই, আদৌ কি ধ্বংসপ্রিয় তালিবানের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন?