কলকাতা:  মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টসিলিজুমাব কাণ্ডের জোড়া তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ল স্বাস্থ্য ভবনে। 


কলকাতা মেডিক্যাল সূত্রে জানা গিয়েছে, তদন্তে কমিটির রিপোর্টে টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন তোলার ক্ষেত্রে বেনিয়মের উল্লেখ করা হয়েছে। 


সূত্রের খবর, রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিয়ম ভেঙে ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন চিকিৎসক দেবাংশী সাহা। একজন মেডিক্যাল অফিসারের সাক্ষরের ভিত্তিতে এই ইঞ্জেকশন দেওয়া যায় না। মেডিক্যাল অফিসার বা হাউস স্টাফের সাক্ষরে এই ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা নয়।’


রিপোর্ট অনুয়ায়ী, ‘প্রয়োজন ছিল আরএমও, সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার, ভিজিটিং ডক্টরের সাক্ষর।  এছাড়া, ইঞ্জেকশন নেওয়ার সময়েই কোন রোগীর জন্য নেওয়া হচ্ছে উল্লেখ থাকতে হবে। কী ডোজে দেওয়া হবে টসিলিজুমাব তার উল্লেখ থাকতে হবে আবেদনে।’ 


রিপোর্টে উল্লেখ, কোনও নিয়মই এক্ষেত্রে মানা হয়নি। দুটি তদন্ত রিপোর্টই স্বাস্থ্য ভবনে পাঠিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 


মেডিক্যাল হাসপাতাল সূত্রে খবর, ফেব্রুয়ারিতেই মেডিক্যালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিয়েছেন নির্মল মাজি। এই মর্মে  সেই ইস্তফাপত্র চেয়ে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। 


করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় যখন টালমাটাল গোটা দেশ থেকে রাজ্য, তখনই সামনে আসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১১ লক্ষ টাকার করোনার চিকিৎসার ইঞ্জেকশন গায়েবের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। 


খাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ও বহু মূল্যবান ২৬টি টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকে তা ঘিরেই রাজ্য চিকিৎসা ও রাজনৈতিক মহলে জোর হইচই শুরু হয়। 


ঘটনার সূত্রপাত গত মঙ্গলবার। ওইদিন ওয়েস্ট বেঙ্গল কংগ্রেস সাপোর্টার্স নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে একাধিক নথি-সহ সরাসরি চিকিৎসক দেবাংশী সাহার বিরুদ্ধে এই বিস্ফোরক অভিযোগ করা হয়। 


ঘটনায় নাম জড়ায় তৃণমূল বিধায়ক ও চিকিৎসক নেতা নির্মল মাজির। অভিযুক্ত চিকিৎসক তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা হয়। যদিও এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ মানতে রাজি নন নির্মল মাজি। 


তিনি বলেন, আমি তো আগেই রোগী কল্যাণ সমিতির পদ থেকে পদত্যাগ করি। নির্চনের কাজে যুক্ত ছিল। আমিই তো তদন্ত করতে বলি। আমি দালালচক্রের কথা বলেছিলাম। তাই নাম ফাঁসিয়ে দিয়েছে। তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করব।


এরপরই, টসিলিজুমাব উধাও কাণ্ডে দু’টি তদন্ত কমিটি তৈরি করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।


পাশাপাশি, কলকাতা মেডিক্যালে টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন উধাওকাণ্ডে হাইকোর্টে দায়ের হয়েছে জনস্বার্থ মামলা। শুক্রবারই বিষয়টি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন আইনজীবী তাপস মাইতি। 


উচ্চ আদালতে মামলা দায়েরের অনুমতি চান। আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতেই এই মামলা দায়ের হয়েছে। সম্ভবত আগামী সপ্তাহে হাইকোর্টে টসিলিজুমাব উধাও সংক্রান্ত মামলার শুনানি হবে। 


কী এই টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন?


চিকিৎসকরা বলছেন, টসিলিজুমাব হল ইনটারলিউকিন সিক্স গোত্রের ওষুধ। এটি একটি অ্যান্টিবডি মেডিসিন।


কী কাজে ব্যবহার হয় এটি? 


চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মানুষের শরীরে যখন ভাইরাল ইনফেকশন হয়, তখন শরীরের ভিতরে সাইটোকাইন বলে একটি রাসায়নিক তৈরি হয়। 


আর যখন এই সাইটোকাইনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন শরীরে মধ্যে বিভিন্ন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করে। শরীরে এই অনিয়ন্ত্রিত সাইটোকাইনকেই নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন।


শুধু তাই নয়, সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে,  করোনা আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন প্রয়োগে ইতিবাচক ফল মিলেছে। 


আর তারপর থেকেই করোনাকালে হাহাকার পড়ে গিয়েছে এই ইঞ্জেকশনের। ফুসফুস বিশেষজ্ঞ সুজন বর্ধন বলেন, স্টেরয়েড দেওয়ার পরও সাইটোকাইন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, তখন এটা প্রয়োগ করা হয়। আগে পরীক্ষা করে দেখা হয় অন্যান্য ইনফেকশন আছে কি না, কারণ এটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


এই ইঞ্জেকশনের দামও অনেকটাই। বর্তমানে একটি ইঞ্জেকশনের দাম ৩৮ হাজার ৪৫০ টাকা। আগে দাম ছিল ৪২ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে।


এই প্রেক্ষাপটে, গত ৩ মে, টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন নিয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী, বর্তমানে খোলা বাজারে এই ইঞ্জেশন পাওয়া যায় না। রাজ্যে একটি মাত্র সংস্থাই টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন সরবরাহ করে। 


রাজ্যের নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনও সরকারি হাসপাতালে কোনও রোগীর টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন লাগলে, সেই রোগীর সব নথি স্বাস্থ্যভবনে পাঠাতে হবে। সেখান থেকে নথি যাচাই করে সবুজ সংকেত মিললে, তবেই দেওয়া হয় এই ইঞ্জেকশন। 


অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোম এবং ইঞ্জেশকন প্রস্তুতকারী সংস্থার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজও করে রাজ্য সরকার। 


চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, এটা শুরুতে ব্যবহার করা হয় না। একেবারে লাস্ট স্টেপ হিসেবে ব্যবার। অত্যন্ত সাবধানে। খুব দামি ওষুধ খোলা বাজারে পাওয়া যায় না।


সূত্রের খবর, বর্তমানে রাজ্য সরকারের কাছে কিছু টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন রয়েছে।  বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমগুলির কাছে এটি প্রায় নেই বললেই চলে।