'নাহ, মহালয়ার ভোরে রেডিও অফিস ছাড়া দাদু কোনওদিন কারও অনুরোধে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পাঠ করেননি। কত অনুষ্ঠান, মণ্ডপের উদ্বোধনে দাদুর গলায় স্তোত্রপাঠ শুনতে চেয়েছেন অগণিত মানুষ, দাদু কিন্তু প্রতিবার ফিরিয়েই দিয়েছেন।' বলতে বলতে খানিক থামলেন বছর তেষট্টির শোভন গোপাল দত্ত। শৈশবের স্মৃতি উসকে চলল স্মৃতি রোমন্থন। মহালয়ার দিন এবিপি আনন্দ লাইভের সঙ্গে এভাবেই পুরনো সেই দিনের কথা ভাগ করে নিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দৌহিত্র শোভন গোপাল দত্ত।


আপামর বাঙালির কাছে যিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, শোভন গোপাল দত্তের কাছে তিনি দাদু। প্রতি মহালয়ার ভোরে যে মন্ত্রমুগ্ধ কণ্ঠ কাকভোরেও বাঙালিকে জেগে থাকতে বাধ্য করে, সেই কণ্ঠেই ভূতের গল্প, কড়া শাসন শুনে বড় হয়েছেন শোভন গোপাল বাবু। খুব ছোট বয়সেই বাবা মারা গিয়েছিলেন, মামাবাড়িতে দাদুর কাছেই তাঁর বড় হওয়া। তাই স্মৃতির পসরাও বিস্তর। পাশে শুয়ে ঘুমোনো থেকে শীতের দুপুর, গরমের ছুটির বিকেল আর ম্যাজিকের ছোটবেলার দিনগুলো তাঁর কাছে আজও একইরকম তরতাজা। 


১৩৩৯ বঙ্গাব্দ এবং ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের আশ্বিন মাস। দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর ভোরে তৎকালীন ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ নামে খ্যাত কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী। যার রচনা করেন বাণীকুমার, সুর সংযোজনায় পণ্ডিত হরিশচন্দ্র, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। চণ্ডীপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এরপর থেকে আজও দেবীপক্ষের সূচনা মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী'। 


পঞ্চাশের কোটা পেরিয়েছেন শোভন গোপাল দত্ত। তবে এই দিনটা এলেই শৈশবের দিনগুলোয় ফিরে যেতে বড্ড মন চায় তাঁর। ছোটোবেলায় দাদু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে বসেই 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনতেন তিনি। সঙ্গে থাকতেন দিদা, মাসি, ভাই-বোনেরা। 


১৯৭২ সালের পর থেকে নিজেই নিজের রেকর্ড শুনতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। স্তোত্রপাঠের সময়ে আবেগে তাঁর গলা বুজে আসত, অঝোরে জল পড়ত দু-চোখ বেয়ে। শুনতে শুনতেই আবেগাচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন তিনি। 


শোভন গোপাল দত্তের কথায়, 'দাদু বাঙালির কাছে যে ঠিক কী, অনুভব করতে পারি। দাদু-নাতির সম্পর্ক যেমন হয়, আমাদেরও তেমনই ছিল। ওঁর হাত ধরে বহু মণ্ডপ উদযাপনে গিয়েছি, কত গল্প, কত স্মৃতি। আজ ও তাঁর দিয়ে যাওয়া শিক্ষাই সমৃদ্ধ করে আমায়, আমাদের।' 


শুধু এই দিনটা এলেই ফোন আসে, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ। কেউ বাইট চায়, কেউ  জানতে চায় পুরনো কথা। সারাবছর মনে পড়ে না ভেবে বিরক্ত হন না? কখনও মনে হয় না শুধু এই একটা দিনেই কেন? 


হাসি অমলিন রেখেই শোভন গোপাল বাবু ফের ডুব দিলেন স্মৃতিতে, 'দাদু বলতেন, জন্মদিন যেমন বিশেষ, তেমন সব উদযাপনেরই বিশেষ একটা দিন থাকে।' তাঁর কথায়, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রকে নিয়ে বাঙালি কিন্তু সারাবছর মাতামাতি করে না। দাদুও বাঙালির তেমনই এক উদযাপন। দাদুকে দিয়েই তো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের সূচনা।' 


কোনও খারাপ লাগা? 'নাহ, দাদুই শিখিয়েছিলেন সব পরিস্থিতি সাদরে গ্রহণ করতে', কেমন? '১৯৭৬ সালে উত্তম কুমার ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ করায় একটুও দুঃখ পাননি দাদু। বরং তিনি মনে করতেন, সবাইকে জায়গা দেওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মেরও সুযোগ প্রাপ্য।' বললেন শোভন গোপাল দত্ত। 


জানা যায়, ১৯৭৬-এ এক প্রকার রাজনৈতিক চাপেই সে বার মহালয়ায় পাঠ করেন মহানায়ক। সে বছর মহালয়ার রাতে উত্তমকুমার হাতিবাগানের বাড়িতে এসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কাছে ক্ষমা চেয়ে অনুমতি নিয়ে যান। দ্বিমত করেননি।


তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আঘাত পেয়েছিলেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে। নায়কের চাহিদা তখন তুঙ্গে, অল ইন্ডিয়া রেডিও কর্তৃপক্ষ ভাবলেন এতে রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়বে। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কিছুই জানাননি তাঁকে। পরিবার কানাঘুষো শুনে জানতে পারে, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর বাজবে না। নতুনভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তবে দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর একাধিক ফোন এসেছিল। সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেননি ‘দুর্গা দুর্গতিহারিনী’। প্রত্যাখ্যান এতটাই চড়া ছিল যে ষষ্ঠীর ভোরে ফের বাজানো হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের 'মহিষাসুরমর্দিনী'। 


মহালয়ার ভোরে চিক চিক করছে স্মৃতিরা। চোখে মুখে সেই শৈশবের উচ্ছ্বাস। শোভন গোপাল দত্ত বলে চলেছেন, 'দাদু গল্প করেছিলেন, সালটা ১৯৩৯। ভারতে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কায়েম। হঠাৎই সিদ্ধান্ত হয়েছিল রেডিও-র অফিসকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে দিল্লিতে। প্রতিবাদে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র অফিসের সামনেই ধর্নায় বসেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন বহু নামজাদা মানুষ, গায়ক, গায়িকা। ধরনা চলেছিল বেশ কয়কদিন। অবশেষে চাপের মুখে পড়ে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় ছোটলাট। 


এরকমই হাজারও গল্প আছে, সময়ের নিয়মে তাদের গায়ে ধুলো জমেছে, আবছা হয়েছে বহু মুহূর্ত। শুধু বদলায়নি 'মহিষাসুরমর্দিনী' নিয়ে বাঙালির আবেগ। তাই মহামারী, মারণ ভাইরাসের তাণ্ডব, হাজারও বিধি-নিষেধকে ছাপিয়েও রেডিওর ঘড়ঘড়ানি ভেসে আসবে প্রতি মহালয়ার কাকভোরে। এ নিয়মে কোনও বদল হবে না। প্রতিবছর এঁদো গলির কোনও এক গৃহস্থের বাড়ি থেকে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফের ধরিত্রীর বুক চিরে বেজে উঠবে 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা. . . .।' যাই হয়ে যাক বাঙালি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ভোলে না, বাঙালি মহালয়ার সকালে 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনতে ভোলে না।