সুদীপ্ত আচার্য, কলকাতা: প্রথমে বাংলা। তারপর জীবন বিজ্ঞান। তারপর সংস্কৃত। একের পর এক ক্লাস চলছে। 


করোনার ভীতি কাটিয়ে রাজ্যের স্কুলগুলোতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পঠন-পাঠন ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই ক্লাস কোনও বিদ্যালয়ে চলছে না, চলছে প্রকাশ্য রাজপথে কলেজ স্ট্রিটে।


ভাবছেন পথশিশু অথবা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পরা পড়ুয়াদের জন্য দরদী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই উদ্যোগ? বিষয়টা কিন্তু মোটেই তা নয়। 
ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা, বোর্ডের সামনে মনোযোগী পড়ুয়ারা কেউই কিন্তু কচিকাঁচা নন। 


তবে কি কলেজ স্ট্রিটের রাজপথে সাক্ষরতার ক্লাস চলছে? তাও না। আসলে রাজ্যের সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয়ের হবু শিক্ষক-শিক্ষিকারা আজ রাজপথে ক্লাস করাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা সকলেই হবু শিক্ষক বা শিক্ষিকা।


চাকরিপ্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আন্দোলন কলকাতার রাজপথে নতুন নয়, লাগাতার অনশন, শিক্ষা মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছে গিয়েও চাকরির দাবি জানানোর মতো ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। 


তারপরেও চাকরি না পেয়ে এবার  নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির চাকরিপ্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রতীকী ক্লাস নিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে ব্যস্ত কলেজ স্ট্রিটে।


কারা ও কেন আন্দোলনের পথে?


আন্দোলনকারীদের দাবি, তাঁরা প্রত্যেকেই ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়েছিলেন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক হওয়ার জন্য। ওই বছর নভেম্বরের শেষে নবম-দশম শ্রেণির জন্য এবং ডিসেম্বরের শুরুতে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। 


২০১৭ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশন ফলাফল প্রকাশ করলে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই প্রথম দফায় ভেরিফিকেশন এবং ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পান বলে তাঁদের দাবি। 


ভেরিফিকেশন এবং ইন্টারভিউ এর শেষে ২০১৮ সালের মার্চে নবম দশম শ্রেণি এবং ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির চাকরি প্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশন। 


আন্দোলনকারীদের দাবি, যদিও তাঁরা প্রথম দফায় ভেরিফিকেশন এবং ইন্টারভিউ এর জন্য ডাক পেয়েছিলেন তবুও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হলে দেখা যায় সেই তালিকায় তাদের স্থান হয়নি।


পরিবর্তে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় যাঁদের ভেরিফিকেশন এবং ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়েছিল সেই সমস্ত প্রার্থীরা চূড়ান্ত তালিকা স্থান পান চাকরির নিয়োগপত্র পাবার জন্য। 


আর এই আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নাম চলে যান ওয়েটিং লিস্টে। আন্দোলনকারীদের আরও দাবি, নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হওয়ার জন্যই, তাঁরা প্রথম দফায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পেলেও তাঁদের বঞ্চিত করে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় ডাক পাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়।



কোন পথে আন্দোলন?


এরপর শুরু হয় চাকরির দাবিতে আন্দোলন। ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে টানা ২৯ দিন আন্দোলন ও অনশন করেন চাকরিপ্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকারা। 


সামনেই তখন লোকসভা নির্বাচন, শুধু শিক্ষামন্ত্রী নন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে অনশন প্রত্যাহার করেন চাকরিপ্রার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু এরপরেও তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি মত সরকারের তরফ থেকে নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। 


সরকারের কাছে বারবার দাবি-সনদ পেশ করেও চাকরি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ফের আন্দোলনে বসেন তাঁরা। এবার সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক সংলগ্ন এলাকায় চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি থেকে অবস্থান ও ধর্না কর্মসূচি চালু করেন আন্দোলনকারীরা। দশদিন পর থেকে শুরু হয় অনশন। আজ সেন্ট্রাল পার্কের সেই আন্দোলন ৪৩ দিনে পড়ল আর অনশন ৩৩ দিনে।


এবার নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর চাকরিপ্রার্থী এই শিক্ষক-শিক্ষিকারই অভিনব প্রতীকী আন্দোলনের পথে গেলেন। আজ কলেজ স্ট্রিটে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে তারা প্রতীকী ক্লাসরুমে পঠন-পাঠন করিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। 


আন্দোলনকারী শিক্ষক শিক্ষিকাদের বক্তব্য, সরকার তাঁদের অযোগ্য মনে করছেন, সে কারণে তারা নিয়োগপত্র পাননি, যদিও তাঁরা প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত। 


আন্দোলনকারীরা জানান, আজ যদি তাঁরা শিক্ষক পদে নিযুক্ত হতেন তাহলে তাঁদের রাজ্যের কোনও বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের দাবি অনুযায়ী, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির জন্য তাঁরা আজ ক্লাসরুমে ক্লাস নেওয়া থেকে বঞ্চিত।


তাঁরা যে যোগ্য শিক্ষক, এবং সুযোগ পেলে রাজ্যের চাকরিরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতো তাঁরাও যোগ্যতার সঙ্গে পড়ুয়াদের শিক্ষা দিতে পারেন সেটা দেখানোর জন্যই তাদের এই প্রতীকী ক্লাস রুমের ব্যাবস্থা। 


আজ দুপুরে এই প্রতীকী ক্লাস শুরু হয়। চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা। বিদ্যালয়ের মতোই আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা রাজপথে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে প্রতীকী ক্লাসের সূচনা করেন, যেরকমটা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে হয়ে থাকে। 


এরপর শুরু হয় একের পর এক ক্লাস। প্রথমে বাংলা, তারপর জীববিজ্ঞান এরপর সংস্কৃত একের পর এক রাজপথে চলতে থাকে প্রতীকী ক্লাস নেওয়ার কাজ। 


পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে হেলান দিয়ে রাখা সাদা বোর্ডে মার্কার পেন দিয়ে লিখে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা পড়া বোঝাতে থাকেন।   সামনের রাস্তায় বসে পড়া বুঝে নেন অন্য আন্দোলনকারী হবু শিক্ষকরা। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়ান কলেজ স্ট্রিটে আসা পথচারীরাও।


আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। ভোট প্রক্রিয়া শুরু হলেও যেহেতু তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বেশ কয়েক বছর আগে শুরু হয়েছে, সে কারণে ভোটের জন্য তাঁদের নিয়োগের কাজে বাধা পড়ার কথা নয়।


প্রায় দুই থেকে তিন হাজার চাকরিপ্রার্থী নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওয়েটিং লিস্টে রয়েছেন। সরকারের কাছে তাঁদের আবেদন অবিলম্বে তাঁদের নিয়োগের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ করুক সরকার।


রাজপথের ক্লাসরুমে এক শিক্ষিকা সাহিত্য চয়ন থেকে পড়াচ্ছিলেন শঙ্খ ঘোষের লেখা "জলই পাষাণ হয়ে আছে" কাব্য সংকলন এর "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি" কবিতাটি।


যতদিন না ওয়েটিং লিস্টে থাকা সকল চাকরিপ্রার্থী নিয়োগপত্র পাচ্ছেন ততদিন একসঙ্গে থেকে দাবি আদায়ের অনড় মনোভাবই যেন ফুটে উঠেছিল এই প্রতীকী ক্লাস থেকে।


Education Loan Information:

Calculate Education Loan EMI