কলকাতা: হাইকোর্টে চলছে নারদ-মামলার শুনানি। পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে সিবিআইয়ের মামলা স্থানান্তর নিয়ে আবেদনের শুনানি শুরু হয়। এদিন ২ দফায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে শুনানি চলার পর দিনের মতো শেষ হয় প্রক্রিয়া। আগামীকাল পুনরায় চলবে শুনানি। 


এদিন শুরুতেই সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা তাঁর সওয়ালে বলেন, ‘আমরা এখানে জামিন খারিজের আবেদন করিনি। আমরা চাই, গ্রেফতারির পর নিম্ন আদালতের যাবতীয় বিচারপর্বে স্থগিতাদেশ।’ 


তিনি বলেন, ‘গোটা প্রক্রিয়াকে কলুষিত বা বিকৃত করা হয়েছে বলে ঘোষণা করুক হাইকোর্ট। এটা করতে গিয়ে জামিন খারিজ করতে হলে সেটা করুক আদালত।’


তুষার মেহতা তাঁর সওয়ালে বলেন, ‘গ্রেফতারির পর যা হয়েছে, দেশ তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসে হয়েছে কিনা সন্দেহ। ক্যাবিনেটের সদস্যরা গিয়ে ধর্না দিচ্ছেন, বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এটা অত্যন্ত লজ্জার ও দুর্ভাগ্যজনক। পরিকল্পিত, সংগঠিত ভাবে লোক এনে সিবিআই অফিস ঘেরাও, পাথর ছোড়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা ধর্না দিয়েছেন।’


তুষার মেহতাকে প্রশ্ন করে বিচারপতি সৌমেন সেন জানতে চান, ‘চার্জশিট কি অনলাইনে পাঠানো হয়েছিল? নাকি সিবিআই আধিকারিকরা আদালতে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন? 


একইসঙ্গে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ঠিক কোন সময় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল? মানুষ কখন থেকে ঘেরাও শুরু করে সেটা জানাবেন,কারণ এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।’


এরপর তুষার মেহতা বলেন, ‘সেদিন গোটা ঘটনায় বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। যে মন্ত্রীরা ঘেরাও করেছিলেন তাঁরা শুধু সাধারণ মানুষ নন। তাঁরা সাংবিধানিক পদের অধিকারী।’ 


তুষার মেহতা তাঁর সওয়ালে আরও বলেন, ‘রাজ্যে উঁচু পদে থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হলেই বিক্ষোভ-হামলা হচ্ছে। পরিকল্পিত বিক্ষোভ এবং হামলার ঘটনা ঘটে। মদন মিত্রর গ্রেফতারির সময়ও এই ঘটনা ঘটেছিল। সিবিআইয়ের গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সিবিআইয়ের কনস্টেবল আহত হয়েছিলেন।’


তখন তুষার মেহতাকে বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন, ‘সেই সময় কি অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনের আবেদন করেছিলেন? করে থাকলে সেই আবেদন কি মঞ্জুর হয়েছিল?’


উত্তরে সলিসিটার জেনারেল বলেন, ‘রাজীব কুমারের ক্ষেত্রেও সিবিআইকে হেনস্থা হতে হয়েছিল। হুমকি দেওয়া হয়েছিল, পরে ধর্নাও দেওয়া হয়। সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরেও দীর্ঘদিন ধর্না কর্মসূচি চলেছে।’


সলিসিটর জেনারেলকে তখন বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন, ‘ঘেরাও, ধর্নার সঙ্গে অভিযুক্তদের প্রত্যক্ষ যোগ বা মদত না থাকলে জামিন বাতিল কেন হবে? একইসঙ্গে বিচারপতি সৌমেন সেন প্রশ্ন করেন, ‘আগের ধর্না বা ঘেরাওয়ে বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত না হলে সেই উদাহরণ এখন কীভাবে যুক্তিসংগত?’


এরপর, মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি হয়। তারপর পুনরায় শুরু হয় শুনানি। সেখানে সলিসিটর জেনারেল সওয়াল করেন, ‘বিক্ষোভ-ধর্না, রাজ্যের মন্ত্রীদের অবস্থান, চাপের রাজনীতি-- এসব থেকে মাননীয় বিচারক বিচ্ছিন্ন রাখতে পেরেছিলেন কি না মানুষের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে। রায় পক্ষপাতদুষ্ট না হলেও মানুষের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে। এটা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু সুবিচার শুধু হলেই হবে না। সুবিচার যে হয়েছে, সেটা মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে।’


তখন বিচারপতি সৌমেন সেন তুষার মেহতাকে প্রশ্ন করেন, ‘মামলা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে হয়েছে, ভার্চুয়ালি হয়েছে। বিচারককে প্রভাবিত করার সুযোগ কীভাবে হল?’ 


একইসঙ্গে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় সলিসিটর জেনারেলকে বলেন, ‘দেশের বিচারালয়গুলিতে যে কেউ এজলাসে মামলা শোনার জন্য থাকতে পারেন। সেখানে হাই প্রোফাইল বা লো প্রোফাইল দর্শক বলে কিছু হয় না।’ তুষার মেহতাকে বিচারপতির প্রশ্ন, ‘আমাদের দেশে যে কোনও সিদ্ধান্তর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার আছে। তাহলে বিচারক কীভাবে প্রভাবিত হবেন? যদি এত অনিয়ম হয় তবে সিবিআইয়ের আইনজীবী মামলা মুলতুবির জন্য কেন বলেননি?’


জবাবে   তুষার মেহতা বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ পাথর ছুড়ছেন, মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায় বসে আছেন। আমরা কী করব, আধিকারিকরা কী করবেন?’


এরপরই দিনের মতো শেষ হয় শুনানি-পর্ব। আগামীকাল ফের হবে শুনানি প্রক্রিয়া।