সৌভিক মজুমদার, কলকাতা: নারদ মামলা স্থানান্তর নিয়ে সিবিআইয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সওয়াল করলেন আরেক হেভিওয়েটদের পক্ষের আইনজীবী সিদ্ধার্থ লুথরা।


শুরুতেই তিনি বলেন, বিচারপতিরা সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করার শপথ নেন। তাঁরা মানুষের ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হন না। সলিসিটার জেনারেল তথা সিবিআইয়ের আইনজীবী বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত করার যে অভিযোগ তুলেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ টেনে লুথরা বলেন, তুষার মেহতার বক্তব্য যদি স্বীকার করেও নিই, তাহলে আমরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ব। তাহলে আমাদের বলা হবে যে, মাননীয় বিচারপতিরা যে শপথবাক্য পাঠ করেছেন সেটা একটা কাগজ ছাড়া কিছু নয়। 


তিনি আরও বলেন, আমার বিশ্বাস, যে মাননীয় বিচারপতিরা জামিনের ওপর স্থগিতাদেশ দিতেন না। ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে জামিন স্থগিত করেছেন। সিবিআই অত্যন্ত সৃজনশীলভাবে তাদের বক্তব্য পেশ করেছে। জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সমতুল্য ক্ষমতা নিম্ন আদালতের আছে।


এরপর বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল লুথরাকে প্রশ্ন করেন, এই বক্তব্যের মানে কী? আপনি কি বলতে চাইছেন যে, বিচারপতিরা তাঁদের গ্রহণ করা শপথ মেনে চলেন না? 


উত্তরে সিদ্ধার্থ লুথরা বলেন, না, আমি বলতে চাইছি, নিম্ন আদালতের বিচারকরা শপথের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নির্ভয়ে রায়দান করেন। 


যে শপথের মর্যাদা রক্ষার কথা আমরা সবসময় বলি, বিশেষ বিচারক কি সেটা রক্ষা করবেন না?  এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, মামলায় একজন জিতবে একজন হারবে।


আদালতের নিয়ম অনুযায়ী রায় পছন্দ না হলে, উচ্চতর আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। একটা রায় আপনার বিরুদ্ধে গেছে বলে সেটাই মামলা স্থানান্তরের কোনও কারণ হতে পারে না।


এরপর বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, বিচারক বা বিচারপতিরা শপথ মেনে চলেন, কিন্তু তাঁরাও মানুষ, কম্পিউটার বা রোবট নন। 


১৭ই মে হেভিওয়েটদের গ্রেফতারির দিনে বিক্ষোভের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, আইনজীবী লুথরা প্রতিযুক্তি দেন, বাইরে যদি প্রচণ্ড গন্ডগোল চলে, তাহলেও মাননীয় বিচারপতিদের কাজে কে বাধাদান করবে? 


তিনি উল্লেখ করেন, ৮টা ১০-এ সিবিআই হেভিওয়েটদের গ্রেফতার করেছে। কিন্তু, অ্যারেস্ট মেমোতে ৮ টা ৪৫ দেখিয়েছে। এটা কি সিবিআই-এর গ্রেফতারির সংজ্ঞা?


জনপ্রতিনিধিদের গ্রেফতার করার আগে অনুমতি নিতে হয়। এখানে গ্রেফতারের পরে নেওয়া হয়েছে। সিবিআই-এর আধিকারিকরা দুপুর ১ টার সময় রাজ্যপালের অফিসার বাইরে বসেছিলেন।  সিবিআই সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে আইনকে নিয়ে বিদ্রূপ করেছে। আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। 


তিনি আরও বলেন, হেভিওয়েটদের তো বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, অ্যারেস্ট মেমোতে গ্রেফতারির স্থান নিজাম প্যালেস কেন দেখাচ্ছে সিবিআই? এটা সাংবিধানিক নিয়মের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। 


তারপরেও সিবিআই নীতি-নৈতিকতার কথা বলছে? দায়সারা কাজ করে সেটাকে ন্যায্য বলে উপস্থাপিত করতে চাইছে? কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন লুথরার। 


এরপর হেভিওয়েদের আইনজীবী বলেন, অ্যারেস্ট মেমো অনুযায়ী ৪ নেতা-মন্ত্রীকে নিজাম প্যালেস থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।  হলফনামা থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেককেই সকালে গ্রেফতার করা হয়েছে।   তাহলে অ্যারেস্ট মেমো কি পরে যুক্ত করা হয়েছে ? 


ই প্রেক্ষিতে, বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল প্রশ্ন করেন, সেটা হলে কি বিক্ষোভের অধিকার অর্জন করা যায়? প্রতি যুক্তিতে লুথরা বলেন,  প্রোটোকল না মেনেই মদন মিত্রকে গ্রেফতার করা হয়। 


২০টির ও বেশি গাড়ি নিয়ে সিবিআই আসে। পরোয়ানা ছাড়াই একজন ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ ছিল।


তারপরও বলা হচ্ছে, সিবিআই অফিসের বাইরে লোকের জমায়েত ছিল। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্যে সিবিআই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সাহায্য চাইতে পারত।  কিন্তু তারা যেভাবে গ্রেফতার করেছে, তারপর আর সাহায্যও চাইতে পারেনি। 


এরপর বিচারপতি সৌমেন সেন প্রশ্ন করেন,  গ্রেফতারির বৈধতা কি এই মামলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক? সিবিআই-এর বক্তব্য, তারা বিক্ষোভের কারণে অভিযুক্তদের আদালতের সামনে পেশ করতে পারেনি।


উত্তরে লুথরা বলেন,  আমার মনে হয়, সিবিআই হেফাজতে পায়নি, কারণ, গ্রেফতারিটা ছিল অতিরঞ্জিত, আইন এটার অনুমতি দেয় না। আগে সিবিআই বলেছিল, অভিযুক্তদের হেফাজতে নেওয়ার দরকার নেই এবং আর তদন্তেরও দরকার নেই। 


হঠাৎ করে ৭ই মে সব শেষ হয়ে গেল? হঠাৎ করেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র ও শোভন চট্টোপাধ্যায়, এই ৪জনকে গ্রেফতার করা হল?


এরপর বিচারপতি হরিশ টন্ডন বলেন, এই প্রশ্নগুলো জামিনের সঙ্গে সংযুক্ত।  আমরা জামিনের সূক্ষ্মতা বিচার করছি না। 


তুষার মেহতা বলেছেন যে, একটা বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, যেটাকে তিনি মানুষের জমায়েত বা বিক্ষোভ বলে অভিহিত করেছেন। 
জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বিশেষ আদালত নিতে পারে। 


এরপর, লুথরার উদ্দেশ্যে বিচারপতি টন্ডন প্রশ্ন করেন, মামলার এই পর্বে গ্রেফতারির বৈধতা নিয়ে কি বৃহত্তর বেঞ্চ আলোচনা করতে পারে?


উত্তরে লুথরা বলেন,  কাজ করতে পারছে না বলে সিবিআই বিচারপতিদের সামনে মনগড়া কথা বলেছে। সিবিআই-এর অভিযোগ মিথ্যা। আমি তা প্রমাণ করে দেব। 


তখন সিবিআই-এর ঘর ভেঙে যাবে। সিবিআই দাঁত মুখ চেপে মিথ্যা বলছে। সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, ১৭ তারিখ, নিজাম প্যালেস থেকে ঢোকা বেরনো ও আদালতে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে কোনও বাধা সৃষ্টি হয়নি। 


এই সওয়ালের মধ্যেই বৃহস্পতিবারের মতো শুনানি শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী শুনানি মঙ্গলবার।