কলকাতা:  জামিন পেয়েই কাজে নেমে পড়লেন কলকাতা পুরসভার বোর্ড অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্সের চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম।  শুক্রবার রাতে তিনি ঘুরে দেখেন ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন জায়গা। পরে হাইড রোড ধরে তারাতলা পর্যন্ত রাস্তা পরিদর্শন করেন ফিরহাদ হাকিম। 


অন্যদিকে, কলকাতা পুরসভা সূত্রে খবর, শনিবার দুপুর একটা থেকে দুটো পর্যন্ত ‘টক টু কেএমসি’ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিষেবা সংক্রান্ত অভাব-অভিযোগ কলকাতার নাগরিকরা পুরসভাকে জানান। নারদ মামলায় ১৭ মে ফিরহাদ হাকিম গ্রেফতার হওয়ার পর বন্ধ ছিল এই অনুষ্ঠানটি।


নারদ মামলায় শর্তসাপেক্ষে ফিরহাদ হাকিম-সহ চার হেভিওয়েট নেতামন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। 


১৭ মে অর্থাৎ গত সপ্তাহের সোমবার সকালে আচমকাই  এই চার হেভিওয়েটকে গ্রেফতার করে সিবিআই।  প্রচুর কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে যান সিবিআই অফিসাররা। 


তারপর নিজাম প্যালেসে তুলে এনে তাঁদের অ্যারেস্ট মেমোতে সই করানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচ বছর আগের নারদ-মামলায় একসঙ্গে চার হেভিওয়েটের গ্রেফতারি সাড়া ফেলে দেয় রাজ্য রাজনীতিতে। কিন্তু, তারপর এই বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াই একের পর এক নতুন বাঁক নেয়। 


১৭ মে অর্থাৎ গ্রেফতারের দিন সন্ধেতেই চার হেভিওয়েটকে জামিন দেয় বিশেষ সিবিআই আদালত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই  নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে পৌঁছে যায় সিবিআই। রাতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দালের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়ে দেয়। ফলে জেল হেফাজতে যেতে হয় চার হেভিওয়েটকে। 


২১ মে  চার হেভিওয়েটের জামিন-মামলার শুনানিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল এবং বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতভেদ তৈরি হয়।  বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় চার হেভিওয়েটের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুরের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল জামিন মঞ্জুরের পক্ষপাতী ছিলেন না। 


শেষমেশ চার হেভিওয়েটকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। ডিভিশন বেঞ্চে দুই বিচারপতির মধ্যে মতভেদ তৈরি হওয়ায়, মামলাটি পাঠানো হয় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে। গত সোমবার পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে এই মামলার প্রথম শুনানি ছিল। কিন্তু, তার আগে রবিবার রাতেই  চার হেভিওয়েটকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় সিবিআই। 


সেই আবেদনে কিছু ত্রুটি থাকায় পরদিন, সোমবার ফের নতুন করে আবেদন জানানো হয়।  সেদিনই কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে জামিন-মামলার শুনানি ছিল। সুপ্রিম কোর্টের মামলার প্রসঙ্গ তুলে, বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় সিবিআইয়ের আইজীবীর উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, সুপ্রিম কোর্ট এখনও মামলা গ্রহণ করেনি। আমরা শুনানি শুরু করলে আপনাদের অধিকার কীভাবে খর্ব হবে?


উত্তরে সিবিআইয়ের আইনজীবী, সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেন,  অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর, তাই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছি। এখন হাইকোর্ট যা বলবে তাই আমরা মেনে নেব। সেদিন শুনানি চলাকালীন সিবিআইয়ের উদ্দেশে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় আরও প্রশ্ন করেন, বেশ কয়েক বছর আগে নারদ মামলা শুরু হয়েছে। এতদিন আপনারা গ্রেফতারের প্রয়োজনীয়তা মনে করলেন না, গ্রেফতারির পর তাঁরা যখন জামিন পেলেন, তখনই জামিন খারিজের জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছেন। 


বিচারপতি সৌমেন সেন সিবিআইয়ের উদ্দেশে মন্তব্য করেন, সিআরপিসি-র ৪০৭ নম্বর ধারায় বিস্তৃত ক্ষমতা রয়েছে। নিম্ন আদালতে জামিন খারিজ নিয়েও আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আপনারা শুধু সেদিনের ঘটনাক্রম ব্যাখ্যা করে আদালতে এসেছিলেন। 


এর প্রেক্ষিতে চার হেভিওয়েটের আইনজীবী সিদ্ধার্থ লুথরা বলেন, শুধুমাত্র চিঠির ভিত্তিতে জামিনের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ায় সুবিচার হয়নি। ধৃতদের বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সিআরপিসি-র ৪০৭ ধারায় এভাবে জামিনের ওপর স্থগিতদেশ কি দেওয়া যায়? 


তখন নেতা-মন্ত্রীদের আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারপতি সৌমেন সেন আবার প্রশ্ন করেন, আপনি বলছেন, ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের নির্দেশের কপি দেখেনি? উত্তরে হেভিওয়েটদের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, না। যদিও, হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল বলেন, চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়ার আগে নির্দেশনামার কপি দেখেছি আমরা। 


পরদিন সুপ্রিম কোর্টেও নারদ-মামলার শুনানিতে বড়সড় ধাক্কা খায় সিবিআই। চার হেভিওয়েটকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেলেও, সেখানে বিচারপতিদের একের পর এক কড়া প্রশ্নের মুখে পড়েন সিবিআইয়ের আইনজীবী। 


সলিসিটার জেনারেল তথা সিবিআই এর আইনজীবী তুষার মেহতা রাজ্যের বাইরে মামলা স্থানান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য আবেদন করলে, তাতে গুরুত্ব দেয়নি সর্বোচ্চ আদালত। এরপরই হাইকোর্টে মামলা ফেরত পাঠানোর পক্ষে সায় দেন সলিসিটর জেনারেল। নিজেরা মামলা করে, নিজেরাই সেই মামলা প্রত্যাহার করে তারা। 


ফলে মামলা আবার ফিরে আসে কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে। শুক্রবার সেই বেঞ্চই চার হেভিওয়েটের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করে।