সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম ঝুলন যাত্রা। দ্বাপর যুগে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ঝুলন উৎসব এর সূচনা হয়েছিল। ‘ঝুলন’ শব্দটি এসেছে হিন্দির ‘ঝুলা’ অর্থাৎ ‘দোলনা’ থেকে।


ঝুলন উৎসব কে ঘিরে রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। তার মধ্যে অন্যতম হল দোলনায় রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি স্থাপন করে দোলানো। শ্রাবণ মাসের শুক্লা দ্বাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে চলে ঝুলন উৎসব।


শ্রাবণী পূর্ণিমাকে তাই ঝুলন পূর্ণিমাও বলা হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার যে যুগল মূর্তি, তাকে কল্পনা করেই বৈষ্ণবদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই উৎসব। মথুরা-বৃন্দাবনে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই উৎসবে সামিল হন। 


বাংলাতেও ঝুলন উৎসব এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বিভিন্ন মঠ মন্দিরে তো বটেই বাড়িতেও ধুমধাম করে ঝুলন উৎসব পালন করা হয়। বহু জায়গায় চলে হরিনাম সংকীর্তন। ঠাকুরকে নানা ধরনের ফল, মিষ্টি, লুচি ও সুজি দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়।


ধর্মীয় আচার এর পাশাপাশি সামাজিকভাবেও এই উৎসবের একটা বড় গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ছোটরা নানা ধরনের পুতুল, গাছপালা, নুড়ি পাথর দিয়ে ঝুলন সাজায়। প্রতিটি সাজানোর মধ্যে একটা গল্প থাকে। 


সেখানে যেমন শ্রীকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে নানা গল্প থাকে, যেমন কালিয় দমন, বক রাক্ষস বধ, পুতনা বধ প্রভৃতি তেমনই আবার আধুনিক গ্রাম, শহর, পাহাড়, নদী এসব দিয়েও সাজানোর রীতি রয়েছে।


পাঁচ দিনব্যাপী ঝুলন যাত্রার শেষ দিন হল ঝুলন পূর্ণিমা। ঝুলন পূর্ণিমার আরেক সামাজিক দিক হল রাখিবন্ধন। তাই অনেকে একে রাখি পূর্ণিমা বলেন।


বাংলার ঘরে ঘরে ভাইয়ের হাতে রাখি পরিয়ে দেন বোনরা। আর এই রাখিবন্ধনকে হাতিয়ার করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


সালটা ১৯০৫। ১৯ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করলেন। ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলায় যে জাতীয়তাবাদী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠছে বাংলা ভাগের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করা। 


এই কাজে তারা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন কে হাতিয়ার করতে চেয়েছিল। কিন্তু এর ফল হল উল্টো। সময়টা শ্রাবণ মাস। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার ঘরে ঘরে রাখি বন্ধন পালন করবে ভাইবোনেরা। 


রবীন্দ্রনাথ এর সুযোগ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির বার্তা দিতে রাখিবন্ধন কর্মসূচির ডাক দিলেন। কোনও রাজনৈতিক বা বৈপ্লবিক দলের ডাকে নয় একজন কবির ডাকে গোটা বাংলা স্তব্ধ হয়ে গেল। 


মূল শোভাযাত্রার পুরোভাগে নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি। তাঁর কণ্ঠে তখন সেই গান “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক হে ভগবান।”  বাংলার ঘরে ঘরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে ভ্রাতৃত্বের বার্তা দিল বাংলা। 


এক ধর্মীয় আচারকে সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলল। রবীন্দ্রনাথ রাখির সুতোয় যে সম্প্রীতির বার্তা গেঁথে দিলেন তাকে ধরে রাখার উত্তর দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালির।