ইম্ফল: পার হয়ে গিয়েছে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়। এখনও অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি মণিপুরে (Manipur Violence)। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, হিংসার ঘটনা সামনে আসছে। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্কটজনক জায়গায় পৌঁছেছে যে নামাতে হয়েছে সেনাবাহিনী। অসম রাইফেলস-কেও মোতায়েন করা হয়েছে। রাজ্যপাল টি রঞ্জিত সিংহ আইন অমান্যকারীদের দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে চূড়াচাঁদপুর সহ একাধিক জায়গায় (Manipur Violence News)।
মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির অন্তর্ভুক্ত করার দাবিকে ঘিরেই অশান্তির সূত্রপাত (ST Reservation)। ছাত্র সংগঠন All Tribal Students' Union of Manipur (ATSUM)-এর 'উপজাতি সংহতি মিছিল' ছিল বুধবার। মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতেই মিছিল বার করা হয়। গত মাসে এই মর্মে রায় শোনায় মণিপুর হাইকোর্টও। তাকে ঘিরে ক্রমশ তেতে উঠছিল পরিস্থিতি। সংঘাত পরিস্থিত তৈরি হয় উপত্যকার ভবঘুরে মেইতেই সম্প্রদায় এবং রাজ্যের পাহাড়ি এলাকার উপজাতিদের মধ্যে। বুধবার এই সংহতি মিছিলকে ঘিরেই অশান্তি বাধে।
যে কারণে তফসিলি উপজাতি হিসেবে সংরক্ষণ চাইছেন মেইতিরা
কিন্তু অশান্তির নেপথ্য কারণ জানার আগে, মেইতেইরা কেন তফসিলি উপজাতি আইনে সংরক্ষণ চাইছেন, তা জানা প্রয়োজন। ২০১২ সাল থেকে তফসিলি উপজাতি হিসেবে সংরক্ষণ চেয়ে সরব মেইতিরা। মণিপুর তফসিলি উপজাতি দাবি কমিটি-র তরফে সেই দাবি জোরাল করা হয়। হাইকোর্টে সেই মর্মে আবেদন জমা দেয় মেইতেই ট্রাইব ইউনিয়ন। কেন্দ্রীয় তফসিলি উপজাতি সংক্রান্ত মন্ত্রকের কাছে বিষয়টি সুপারিশ করার আর্জি জানানো হয়। তাদের দাবি ছিল, ভারতীয় সংবিধান মেনে মেইতেইদের উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
মেইতেইদের দাবি, ১৯৪৯ সালে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মণিপুর সংযুক্ত হওয়ার আগে তাঁরা উপজাতি হিসেবেই গন্য় হতেন। কিন্তু সংযুক্তিকরণের পর উপজাতি পরিচয় হারান তাঁরা। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষাও আজ হারাতে বসেছেন তাঁরা। সাংবিধানিক কোনও রক্ষাকবচও নেই। যে কারণে আজ নিজভূমেই কোণঠাসা তাঁরা। ১৯৫২ সালে মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাং যেখানে মেইতেই ছিল, ২০১১ সালের আদমসুমারিতে তা ৪৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। তাই অবিলম্বে মেইতেইদের সংরক্ষণের আওতায় আনার দাবি জানানো হয় আদালতে। মেইতেইদের এই আবেদনে সাড়া দেয় হাইকোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয় সরকারকে।
মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি ঘোষণার বিরোধিতা হচ্ছে যে কারণে
কিন্তু আদালতের নির্দেশের পরও, মেইতেইদের সংরক্ষণের আওতায় আনায় তীব্র আপত্তি মণিপুরের তফসিলি উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত সম্প্রদায়ের। তাদের যুক্তি, জনসংখ্যার নিরিখে তো বটেই, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের নিরিখেও মেইতেইরা আধিপত্য রয়েছে রাজ্যে। রাজ্যের ৬০টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৪০টিই মেইতেই অধ্যুষিত উপত্যকার মধ্য়ে পড়ে। তাই মেইতেইদের সংরক্ষণ দিলে, কর্মক্ষেত্রেও তাঁদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে দাবি তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক মাপকাঠির নিরিখে এগিয়ে থাকা মৈইতেইদের জন্য বাকিদের বঞ্চিত হতে হবে বলে মত কুকি উপজাতি সম্প্রদায়ের সংগঠন 'কুকি ইনপি মণিপুরে'র প্রধান জনঘুলুন হাওকিপের।
মেইতেইদের উপজাতি হিসেবে সংরক্ষণ দেওয়ার বিরুদ্ধে আরও একটি যুক্তি উঠে আসছে, তা হল, মেইতেইদের ব্যবহৃত মণিপুরি ভাষা সংবিধানের অষ্টম শিডিউলের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আগে থেকেই। মেইতেইদের অধিকাংশই মূলত হিন্দু। আগে থেকেই তফসিলি জাতি এবং অন্য়ান্য অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের। সেই অনুযায়ী যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তাঁরা। তাই ঐতিহ্য, সংস্কৃিতির দোহাই দিয়ে আসলে রাজ্যে নিজেদের আধিপত্য কায়েমই মেইতেইদের লক্ষ্য বলে মত তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের।
সংঘাত আজকের নয়, চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে
- মণিপুরে মেইতেই এবং তফসিলি উপজাতিদের এই সংঘাত নতুন কোনও ঘটনা নয়। বরং অশান্তির আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছিল বিগত কয়েক বছর ধরেই। এ বছর এপ্রিল মাসেই চূড়াচাঁদপুরের পরিস্থিতি হিংসাত্মক আকার ধারণ করে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের একটি শরীরচর্চাকেন্দ্র উদ্বোধনের কথা ছিল। তার আগে ওই শরীরচর্চাকেন্দ্রের উপর হামলা চলে।
- ২০২২ সালের অগাস্ট মাসে রাজ্য সরকারের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে চূড়াচাঁদপুর এবং খুপুমের ৩৮টি গ্রামকে সংরক্ষিত বনভূমি এলাকার অন্তর্গত বলে ঘোষণা করা হয়। সেখানে বসবাসকারীদের 'বেআইনি জবরদখলকারী' বলে উল্লেখ করা হয় সরকারের তরফে। তার পর শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। তাকে ঘিরেও সংঘর্ষ বাধে।
কুকিদের দাবি, সরকারি সমীক্ষা এবং উচ্ছেদ অভিযান সংবিধানের ৩৭১-সি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানে মণিপুরের উপজাতি অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় প্রশাসনিক স্বতন্ত্রতার কথা বলা রয়েছে। তার পরেও, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন তফসিলি উপজাতিদের জবরদখলকারী বলে উল্লেখ করেন বলে দাবি কুকিদের। তাঁদের অভিযোগ, সংরক্ষিত বনভূমি হরণ, অভয়ারণ্যে পোস্ত চাষ এবং মাদক কারবারে লিপ্ত বলেও তাঁদের অপমান করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর থেকে যত সময় যাচ্ছিল ঘনিয়ে আসছিল অশান্তি। বুধবার যা কার্যতই বিস্ফোরণের আকার ধারণ করে।