নয়াদিল্লি: 'যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে', মহাকাব্য নিয়ে এই বাক্যবন্ধ সর্বজনবিদিত। বর্তমান দিনে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই প্রবাদকে আরও সার্থক করে তোলে। আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক মহাকাব্য হিসেবেই 'মহাভারত'কে দেখা হয়। ভাইপোদের হটিয়ে ছেলে দুর্যোধনকে সিংহাসনে বসানোর তাঁর অভীপ্সাই প্রকারান্তরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ডেকে আনে। পঞ্চপাণ্ডব ভাইপোই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় তাতে। 'মহাভারতে'র মতো ভারতীয় রাজনীতিতেও কাকা বনাম ভাইপো সংঘাত চোখে পড়েছে বার বার, যাতে সাম্প্রতিকতম সংযোজন মহারাষ্ট্রে শরদ পওয়ার (Sharad Pawar) বনাম অজিত পওয়ারের (Ajit Pawar) মধ্যেকার দ্বন্দ্ব (Maharashtra NCP Crisis)।  ভারতীয় রাজনীতিতে উত্তরসূরি হিসেবে ভাইপোদের ভূমিকাও লক্ষণীয় (Mahabharat)। 


শরদ পওয়ার-অজিত পওয়ার


২০১৯ সালেই শরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন অজিত (Maharashtra NCP Crisis)। জোটের সমীকরণের তোয়াক্কা না করে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে শপথও নিয়ে ফেলেন উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। সে যাত্রায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভাইপোর 'ঘর ওয়াপসি' করাতে সফল হয়েছিলেন শরদ। কিন্তু ২০১৯ এবং ২০২৩ সালের মধ্যে বিস্তর ফারাক। অজিতের পরিবর্তে মেয়ে সুপ্রিয়া সুলেকে নিজের উত্তরাধিকারী করার দিকে শরদ এগোচ্ছেন বুঝে, আগেভাগেই পরিকল্পনা  করে রেখেছিলেন অজিত। সময় বুঝে বিজেপি-র ছত্রছায়ায় গিয়ে উঠেছেন। শুধুমাত্র উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসেননি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির উপর নিজের কর্তৃত্বই স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং একদা শরদঘনিষ্ঠদেরও নিজের দলে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সগর্বে ঘোষণা করেছেন, আসল NCP আসলে তাঁর দখলে রয়েছে, শরদের নয়। সুদক্ষ, কৌশলী রাজনীতিক হিসেবেই পরিচিত শরদ। ভ্রাতুষ্পুত্র অজিত তাঁর শেখানো বিদ্যা, তাঁরই উপর প্রয়োগ করেছেন বলে মনে করছেন অনেকে। 


বালাসাহেব ঠাকরে-রাজ ঠাকরে


মহারাষ্ট্রে শিবসেনাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। অলিখিত ভাবে বালাসাহেব ঠাকরের উত্তরাধীকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজ ঠাকরের নামই উঠে আসত সকলের মুখে। কারণ চলা-বলা, ওঠা-বসা সবেতেই বালাসাহেবকে অনুকরণ করতেন রাজ। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়। বালাসাহেবের নিজের ছেলে উদ্ধব ঠাকরে সযত্নেই রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। কিন্তু শিবসেনার রাশ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাইপোর পরিবর্তে ছেলে উদ্ধবকেই বেছে নেন বালাসাহেব। বাকিটা ইতিহাস। শিবসেনা আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে যায়। তার পর মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে আর পাশাপাশি দেখা যায়নি উদ্ধব এবং রাজকে। এই মুহূর্তে দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও, ফের স্বমহিমায় তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে বলে মত রাজনীতিকদের একাংশ। (Nephews in Indian Politics)


আরও পড়ুন: Tina Ambani: সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা, হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি! আট ঘন্টা ধরে অনিল আম্বানিকে জেরা, হাজিরা স্ত্রী টিনার


 


মহারাষ্ট্রে শিবসেনাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। অলিখিত ভাবে বালাসাহেব ঠাকরের উত্তরাধীকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজ ঠাকরের নামই উঠে আসত সকলের মুখে। কারণ চলা-বলা, ওঠা-বসা সবেতেই বালাসাহেবকে অনুকরণ করতেন রাজ। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়। বালাসাহেবের নিজের ছেলে উদ্ধব ঠাকরে সযত্নেই রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। কিন্তু শিবসেনার রাশ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাইপোর পরিবর্তে ছেলে উদ্ধবকেই বেছে নেন বালাসাহেব। বাকিটা ইতিহাস। শিবসেনা আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে যায়। তার পর মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে আর পাশাপাশি দেখা যায়নি উদ্ধব এবং রাজকে। এই মুহূর্তে দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও, ফের স্বমহিমায় তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে বলে মত রাজনীতিকদের একাংশ।


অখিলেশ যাদব-শিবপাল যাদব


২০১৭ সালে সমাজবাদী পার্টির কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন অখিলেশ যাদব। দলকে নিজের মতো করে সাজাতে বাবা মুলায়ম সিংহ যাদবেরও বিরোধিতা করতে দেখা যায় তাঁকে। দলের রাশ হাতে নিয়েই সবার আগে কাকা শিবপাল সিংহ যাদবকে দল থেকে বহিষ্কৃত করেন। সেই সময় উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির রাজ্য সভাপতি ছিলেন শিবপাল। মুলায়মের পাশে থেকে দলকে প্রতিষ্ঠিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁরও। ভাইপোর বিরুদ্ধে নিজের আলাদা দলও গড়েন শিবপাল। ২০২২ সালে যদিও ফের সমাজবাদী পার্টিতেই ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু দলে আগের মতো সেই দাপট আর নেই তাঁর।


চিরাগ পাসোয়ান-পশুপতি পারস


চিরাগ পাসোয়ান এবং পশুপতি পারসের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। ভাইপো চিরাগকে কোণঠাসা করে ২০২১ সালে পশুপতি লোক জনশক্তি পার্টির সর্বেসর্বা হয়ে উঠলে, আরও তিক্ত হয়ে ওঠে সম্পর্ক। কিন্তু সেই বছরই লোক জনশক্তি পার্টি ভেঙে যায়। দলের প্রতিষ্ঠাতা রামবিলাস পাসোয়ানের ছেলে চিরাগই লোক জনশক্তির প্রধান হন। পৃথক রাষ্ট্রীয় লোক জনশক্তি পার্টি গড়েন পশুপতি।


প্রকাশ সিংহ বাদল-মনপ্রীত বাদল


নিজেহাতে ভাইপো মনপ্রীত বাদলকে গড়েপিটে নিলেও, শিরোমণি অকালি দলের রাশ শেষ পর্যন্ত ছেলে সুখবীর সিংহ বাদলের হাতেই তুলে দেন প্রকাশ সিংহ বাদল। পঞ্জাবের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন মনপ্রীত। দল থেকেও তার পর বিতাড়িত হন। পরে নিজের আলাদা পঞ্জাব পিপলস পার্টি গড়েন মনপ্রীত। কিন্তু ২০১৬ সালে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায় তাঁর দল।


তবে এর ব্যাতিক্রমও রয়েছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। খাতায়কলমে না হলেও, অলিখিত ভাবে মমতার উত্তরসূরি হিসেবেই গন্য হন অভিষেক। তা নিয়ে লাগাতার বিরোধীদের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয় তাঁকে। বাংলার রাজনীতিতে হামেশাই 'পিসি-ভাইপো' কটাক্ষ শোনা যায় বিরোধীদের গলায়। আবার তৃণমূলের অন্দরেও মমতাপন্থী এবং অভিষেকপন্থী, দুই পৃথক শিবির রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। তবে অভিষেক নিজের অবস্থানে এযাবৎ অনড়ই থেকেছেন। মমতাই তাঁর নেত্রী, যতদিন বাঁচবেন, মমতার ছত্রছায়াতেই থাকবেন বলে প্রকাশ্যে একাধিক বার ঘোষণা করেছেন অভিষেক। তাই বিদ্রোহ ঘোষণা হোক বা একনিষ্ঠ হয়ে থাকা, ভারতের রাজনীতিতে ভাইপোরা বরাবরই 'গেম চেঞ্জার'-এর ভূমিকায় থেকেছেন।