নয়াদিল্লি: লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর এখনও একমাসও কাটেনি। আর তাতেই ঘটে গেল উলটপুরাণ। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে যেখানে বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব, ফল ঘোষণার পর জনগণের কাঠগড়ায়  এখন তাঁরাই। কারণ ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা NEET থেকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যপক নিযুক্তির পরীক্ষা NET ঘিরে ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে আসছে। (Exam Paper Leaks)


টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে সাদা খাতা জমা দিয়ে ভূরি ভূরি নম্বর পাওয়া, এমনকি নির্বিচারে গ্রেস মার্ক পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে NEET ঘিরে। আবার দুর্নীতি হয়েছে আঁচ করে পরীক্ষার পরদিনই বাতিল করা হয়েছে NET। সেই নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে গোটা দেশে। কারণ উচ্চশিক্ষা থেকে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অনিয়ম এবং দুর্নীতির এখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে বার বার এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশ। (Recruitment Scams in Recent Years)


AIPMT প্রশ্নপত্র ফাঁস


২০১১ সালে সর্বভারতীয় স্তরের মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে। মূলত হরিয়ানায় পরীক্ষার আগেই টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্র পৌঁছে যায় বলে অভিযোগ সামনে আসে। শুধু তাই নয়,পরীক্ষাকেন্দ্রের ভিতর মোবাইল ফোন, ব্লুটুথ ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষার্থীরা ঢোকেন এবং ফোনে  অপরপ্রান্ত থেকে তাঁদের উত্তর চালান করা হয় বলে জানা যায়। ডাক্তারি পরীক্ষা ঘিরে একটি দুর্নীতিচক্র কাজ করছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেই নিয়ে বিতর্কের মধ্যে বাতিল হয় পরীক্ষা।


সেনায় নিযুক্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস 


২০১৪ সালে রাজস্থানের বিকানেরে সেনায় নিযুক্তির পরীক্ষা ছিল। অল ইন্ডিয়া সেনা ভর্তি-র লিখিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টা। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে খবর সামনে আসে, তাতে পরীক্ষা বাতিল হয়। ন'জনকে গ্রেফতার করা হয়।


উত্তরপ্রদেশ প্রিমেডিক্যাল পরীক্ষা


২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে কম্বাইন্ড প্রিমেডিক্যাল টেস্টের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর মেলে। পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগে বিষয়টি সামনে আসে। তড়িঘড়ি বাতিল হয় পরীক্ষা। কাউন্সেলিং এবং ভর্তিও পিছিয়ে যায়।


উত্তরপ্রদেশ PCS দুর্নীতি


২০১৫ সালে উত্তরপ্রদেশ প্রোভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষা ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ সামনে আসে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে যে  ৫০ শতাংশকে সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, তাঁরা সকলেই একটি বিশেষ জাতির বলে জানা যায়। সেই নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়, তাতে বলা হয়, যে ৮৬ জন SDM হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৫৬ জন একটি বিশেষ জাতির মানুষ। ওই একই সময় UPPSC যাঁদের অন্য পদে নিয়োগ করে, তাঁদের ৫০ শতাংশও একটি বিশেষ জাতির বলে জানা যায়।


NEET-2 প্রশ্নপত্র ফাঁস


২০১৬ সালে জাতীয় মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায় উত্তরাখণ্ডের হলদওয়ানিতে। সেই ঘটনায় সঞ্জয়কুমার প্রভাত, অজয় সিনহা এবং নিশাত আহমেদ, দীনেশ প্রসাদ, বিকাশ কুমারকে গ্রেফতার করা হয়।


পশ্চিমবঙ্গ নিয়োগ দুর্নীতি


পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ সালে নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ২৪ হাজারের বেশি গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে SSC .নিয়োগপ্রক্রিয়া চলাকালীনই মেধাতালিকায় নাম না থাকা অনেকের চাকরি হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালে ওই প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও বহুজন চাকরি পেয়েছেন বলে দাবি সামনে আসে। দীর্ঘদিন ধরে সেই নিয়ে আন্দোলন চলছিল, মামলা ওঠে আদালতে। এই মামলার তদন্তে নেমে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় এবং গহনা উদ্ধার হয়।


২০২৩ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতা হাইকোর্ট সবমিলিয়ে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করে। ২০১৬ সালের গোটা প্যানেলই বাতিল করা হয়। প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর যাঁরা চাকরি পান, ১২ শতাংশ সুদ-সহ তাঁদের বেতন ফেরত দিতে বলা হয়। হাইকোর্টের সেই নির্দেশে আপাতত স্থগিতাদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।


বিহার স্টাফ সিলেকশন পরীক্ষা


২০১৭ সালে বিহার স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। সেই খবর কানে আসতেই বাতিল হয় পরীক্ষা। পঞ্চায়েত সচিব, রাজস্ব কর্মী, ক্লার্ক এবং সহকারী পদে নিয়োগের পরীক্ষা বাতিল হয়। 


গুজরাত পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা


২০১৮ সালে গুজরাত পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে খবর পৌঁছয় এবং পরীক্ষা বাতিল হয়। লোকরক্ষক রিক্রুটমেন্ট বোর্ড পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল। পরীক্ষার্থীর সংখ্য়া ছিল প্রায় ৯ লক্ষ।


SSC CGL দুর্নীতি


২০১৮ সালে স্টাফ সিলেকশন কমিটির দ্বারা গৃহীত সম্মিলিত স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে প্রযুক্তিগত ত্রুটি, ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে আসে। 


রাজস্থান নিয়োগ দুর্নীতি


২০১৯ সালে রাজস্থানে থার্ড গ্রেড লাইব্রেরিয়ান নিয়োগের পরীক্ষা বাতিল হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার জেরেই বাতিল করা হয় পরীক্ষা। ৭০০ শূন্যপদের জন্য ৫৫ হাজার পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগেও ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তদন্তে নামে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।


ন্যাশনাল ল অ্যাডমিশন টেস্ট


করোনা আবহেই ন্যাশনাল ল স্কুল ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি বেঙ্গালুরুর তরফে ২০২০ সালে ন্য়াশনাল ল অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়। কিন্তু সেই পরীক্ষা ঘিরেও ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে আসে। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ওই পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি বাতিল করে। 


IIT-JEE প্রশ্নপত্র ফাঁস


স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্য IIT জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ সামনে আসে ১৯৯৭ সালে। উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। একাধিক মাধ্যমম মারফত পরীক্ষার আগে পড়ুয়াদের হাতে প্রশ্নপত্র পৌঁছে যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও সামনে আসে। সেই সময় সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন (CBSE) পরীক্ষাগ্রহণের দায়িত্বে ছিল। পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০২১ সালে আবারও প্রশ্নপত্র বাতিল হয় এবং তাতে বিদেশি নাগরিকদের যোগসূত্রও উঠে আসে।


গুজরাত সাবঅর্ডিনেট সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের পরীক্ষা


২০২২ সালে গুজরাতের সাবঅর্ডিনেট সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের পরীক্ষা ঘিরে শোরগোল বাধে। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে ব্য়াপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন গুজরাত সাবঅর্ডিনেট সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের চেয়ারম্যান অসিত বোহরা।


AIIMS-এ নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস


২০২৩ সালের জুন মাসে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্য়াল সায়েন্সেস (AIIMS)-এ ৩ হাজার ৫৫ জন নার্সিং অফিসার নিয়োগের পরীক্ষা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে নামে। দুর্নীতির মাথাকে গ্রেফতারও করা হয় বলে খবর সামনে আসে।



ব্যাপম দুর্নীতি


মধ্যপ্রদেশ প্রফেশনাল এগজামিনেশন বোর্ডের পরীক্ষা ব্য়াপম দুর্নীতি নামে পরিচিত। ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল এই পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল। প্রফেশনাল কোর্স এবং সরকারি চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষা ছিল ব্যাপম। সেই পরীক্ষায় ব্য়াপক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি থেকে সরকারি চাকরির পরীক্ষা এবং নিযুক্তিতে দেদার দুর্নীতির কথা জানা যায়। এক ব্যক্তির হয়ে অন্য় জনের পরীক্ষায় বসা, আগে থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালে সেই মামলায় বিশেষ সিবিআই আদালত ৩১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু এই মামলার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১০০ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে, সাজানো পথ দুর্ঘটনা বলে দেখানোর ঘটনাও সামনে আসে। 


তেলঙ্গানা SSC প্রশ্নপত্র ফাঁস


২০২৩ সালে তেলঙ্গনা সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে ঘুরতে থাকে হোয়াটসঅ্যাপে। 


TSPSC প্রশ্নপত্র ফাঁস


গত বছর মার্চ মাসে তেলেঙ্গানা স্টেট পাবলিক সার্ভিস কমিশনের  ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, মিউনিসিপ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিক্যাস অফিসার, জুনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার নিয়োগের পরীক্ষা বাতিল করা হয়। 


অসম HSLC প্রশ্নপত্র ফাঁস


২০২৩ সালের মার্চ মাসে অসম সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়। ইংরেজি এবং জেনারেল সায়েন্সের প্রশ্নপত্র ফাঁস হ.। সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী রনোজ পেগু। তদন্তের রিপোর্ট জনসমক্ষে আনা হয়নি। 


মহারাষ্ট্র HSC প্রশ্নপত্র ফাঁস


২০২৩ সালের মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। প্রথমে অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, রসায়ন এবং পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়ে গিয়েছে। 


REET প্রশ্নপত্র ফাঁস


রাজস্থান সাবঅর্ডিনেট এবং মিনিস্টিরিয়াল সার্ভিসেস সিলেকসন বোর্ডের অধীনে ২০২৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিযুক্তির পরীক্ষা গৃহীত হয়। ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিযোগ সামনে আসে। এই ঘটনায় বেশ কয়েক জনকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। 


আরও পড়ুন: Rahul Gandhi: ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে পারেন, পরীক্ষার অনিয়ম আটকাতে পারছেন না মোদি? প্রশ্ন রাহুলের