নয়াদিল্লি: প্রচারে কোনও খামতি না থাকলেও, ভোট দিতে যেত আগ্রহ বোধ করেননি অধিকাংশ নাগরিকই। যে কারণে ১৯৭৯ সালের পর থেকে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। জনসংখ্যার মাত্র ৩৯.৯১ শতাংশই ভোট দিয়েছেন এবার। এর মধ্যেও ৫৩.৭ শতাংশ সমর্থন পেয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন মাসুদ পেজেস্কিয়ান। উদার সমাজনীতি, মধ্য়পন্থী মাসুদ দেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও, সন্দিহান নাগরিকদের অধিকাংশই। তাঁদের মতে, ক্ষমতায় এলেও সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেইয়ের বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস দেখাতে পারবেন না মাসুদ। যদিও মাসুদকে নিয়ে আশাবাদী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। (Masoud Pezeshkian Profile)
গত ১৯ মে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি। সেই থেকে এতদিন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালাচ্ছিলেন মহম্মদ মোখবর। এবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সেই দায়িত্ব পেতে চলেছেন মাসুদ। রক্ষণশীলতার বেড়াজাল কাটিয়ে মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন যাঁরা, এই মুহূর্তে সেই লক্ষ লক্ষ ইরানীয় নাগরিকের আশা-ভরসা তিনি। কট্টরপন্থী সইদ জরিরিকে হারানোয় তাঁকে নিয়ে বাড়ছে প্রত্যাশাও। মাসুদ সেই স্বপ্নপূরণ করতে পারেন কি না, সেদিকে তাকিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও। (Iran New President:)
১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিম আজেরবাইজানে জন্ম মাসুদের। বাবা আজেরি, মা কুর্দি আজেরি এবং কুর্দ1f ভাষায় কথা বলতে পারেন মাসুদ। ১৯৭৩ সালে বাধ্যতামূলক ভাবে ইরানীয় সেনায় যোগ দেন তিনি। সেই সময়ই চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেনে থেকে ফিরে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। জেনারেল মেডিসিনে ডিগ্রি অর্জন করেন প্রথমে। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় যোদ্ধা হিসেবে যেমন কাজ করেছেন, তেমনই রোগীদের চিকিৎসাতেও নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৮৫ সালে জেনারেল প্র্যাকটিশনার কোর্স সম্পূর্ণ করে মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওলজি পড়াতে শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস থেকে জেনারেল সার্জারি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ইরান ইউনিভার্সিটি থেকে কার্ডিয়াক সার্জারির শিক্ষালাভ। পরবর্তীতে হার্ট সার্জারি স্পেশালিস্ট হন। তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট মহম্মদ খতমি সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও ছিলেন মাসুদ। চিকিৎসা এবং চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগেরও দায়িত্বে ছিলেন। তাবরিজ, আজারশহর ওস্কু থেকে একাধিক বার পার্লামেন্টেও জায়গা পেয়েছেন। ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। ২০১১ এবং ২০২১ সালেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নাম লিখিয়েছিলেন। ২০১১ সালে মনোনয়ন তুলে নেন, ২০২১ সালে তাঁকে ডিসকোয়ালিফাই করা হয়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের নাম লেখান ৬৯ বছর বয়সি মাসুদ।
মাসুদের স্ত্রী ফতেমা মজিদিও পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৩ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ফতেমা। তাঁদের এক সন্তানেরও মৃত্যু হয় ওই দুর্ঘটনায়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দুই ছেলে এবং এক কন্যাকে একাই বড় করেন মাসুদ। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেননি তিনি। তাঁর মেয়ে জাহরা রসায়ন নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। Jam Petrochemical-এ কর্মরতও ছিলেন।
বরাবর সরকার বিরোধী অবস্থানের জন্যই পরিচিত ছিলেন মাসুদ। আন্দোলনকারীদের উপর সরকারি দমন-পীড়নের ঘোর সমালোচক তিনি। তবে নিজেও বিতর্কে জড়িয়েছেন। ২০০৩ সালে ইরানী-কানাডীয় চিত্রসাংবাদিক জাহরা কাজেমির ময়নাতদন্তে উপস্থিত ছিলেন মাসুদ। তিনি জানান, ইন্ট্রাক্রানিয়াল হ্যামরেজেই মারা গিয়েছেন জাহরা। যদিও হেফাজতে জাহরার উপর অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে। জাহরের শরীরের কোথাও আঘাতের কোনও চিহ্নও ছিল না বলে দাবি করেন তাঁর পরিবার। সেই নিয়ে তদন্তের দাবি ওঠে।
২০১৭ সালে মাসুদ স্বীকার করেন, হিজাব ছাড়া মহিলারা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ঢুকতে পারবেন না বলে তিনিই প্রথম উদ্য়োগী হন। দেশে আইন চালু হওয়ার ঢের আগে তিনি এই নিয়ম কার্যকর করেন। ২০২২ সালে মেহসা আমিনির মৃত্যুর পর যদিও সুর বদলান তিনি। জানান, হিজাব না পরার জন্য় কাউকে গ্রেফতার করে পরিবারের হাতে দেহ ফিরিয়ে দেওয়া কোনও মতেই কাম্য নন বলে জানান। ইরানের সমাজ নীতিতে সংস্কার ঘটানোর কথা বললেও, আয়াতোল্লা আসি খামেনেইয়ের বিরুদ্ধাচারণ করবেন না বলে আগেই স্পষ্ট জানিয়েছেন মাসুদ। আগামী দিনে খামেনেইয়ের উত্তরাধিকার নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন মাসুদ। কিন্তু ইরানে উদারপন্থী সমাজনীতি চালু করতে কতটা উদ্যোগী হবেন মাসুদ, সেই নিয়ে সন্দিহান তাঁর সমালোচকরা।