ঢাকা: শেখ হাসিনা সরকারের অবসান ঘটেছে। আপাতত সেনার হাতে আইনকানুনের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকলেও, বৃহস্পতিতেই বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়ে যাবে বলে আশা। কিন্তু তার একদিন আগে পর্যন্ত সংখ্যালঘুদ হিন্দুদের উপর হামলার খবর আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দিরেও হামলা হচ্ছে বলে অভিযোগ সামনে আসছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। (Minority Hindus in Bangladesh)


২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লক্ষ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু জনসংখ্যার হার ৭.৯৭ শতাংশ। তবে জনবিন্যাস সর্বত্র একই নয়। দেশের চার জেলায় হিন্দু জনসংখ্যার হার ২০ শতাংশের বেশি। ঢাকা ডিভিশনের গোপালগঞ্জে হিন্দু জনসংখ্যার হার ২৬ শতাংশ, খুলনায় ২০ শতাংশের একটু বেশি, রংপুরে ঠাকুরগাঁও জেলায় ২২ শতাংশ এবং সিলেটের মৌলবী বাজার জেলায় ২৪ শতাংশ। (Hindus in Bangladesh)


ডিভিশনের নিরিখে দেখলে বরিশালের হিন্দু জনসংখ্যার হার ৮.২৪ শতাংশ, চট্টগ্রামের ৬.৬১, ঢাকায় ৬.২৫, খুলনায় ১১.৫২, ময়মনসিংহে ৩.৯২, রাজশাহিতে ৫.৬৭, রংপুরে ১২.৯৮ এবং সিলেটে ১৩.৫০ শতাংশ।মোট আটটি ডিভিশনে বাংলাদেশকে ভাগ করা হলেও, জনসংখ্য়ার ৪৫ শতাংশের বাসই ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ১ কোটি ৪০ লক্ষ। এর পরই চট্টগ্রাম, ৯০ লক্ষ।


কিন্তু রিপোর্ট বলছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা যেখানে ২২ শতাংশ ছিল, ২০২২ সালে তা ৮ শতাংশে নেমে আসে। সেই নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যা ৭৬ থেকে বেড়ে ৯১ শতাংশ হয়। ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ১ কোটি ১০ লক্ষ বাংলাদেশি হিন্দু দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন বলে দাবি হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের। তাদের দাবি, প্রতিবছর বাংলাদেশ ছেড়ে বেরিয়ে যান ২ লক্ষ ৩০ হাজার হিন্দু। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১০ লক্ষ হিন্দু কার্যতই জনসংখ্যা থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছেন।


১৯৮৮ সালে সংবিধানে রদবদল ঘটিয়ে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের মুখবন্ধে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকে পুনরায় যুক্ত করে শেখ হাসিনার আওয়ামি লিগ সরকার। কিন্তু তার পরও বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তায় খামতি থেকে যায়। কিন্তু মুখে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও, আওয়ামি লিগও সংখ্যাগরিষ্ঠদের তুষ্ট করে চলছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘Islam And Politics in Bangladesh’ বইয়ের লেখক মুবাশর হাসানের মতে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিক নেতাদের বোড়ে ছাড়া অন্য় কিছু নন।


এবারও ছাত্র আন্দোলন হিংসাত্মক আকার ধারণ করার পর থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা সামনে এসেছে একের পর এক। দেশের ২৯টি জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকানপাট, মন্দিরে হামলাস, ভাঙচুর এবং লুঠপাট চলেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরও সংখ্যালঘুদের উপর হামলা অব্যাহত থেকেছে। 


সোমবার থেকে মেহেরপুরে আওয়ামি লিগ নেতার বাড়ি-সহ হিন্দুদের নয়টি বাড়িতে হামলার ঘটনা সামনে এসেছে। আওয়ামি লিগ নেতা পল্লব ভট্টাচার্যের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হোটেল বাজারে একটি বাড়িতে ঢুকে বাড়ির লোকজনকে মারধরের পাশাপাশি, সোনাদানা, দামি জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। মালোপাড়ার ছয়টি বাড়িতে হামলা চলে।  লালপুরে মন্দিরে হামলা চলেছে। পুলিশ, দমকল, কারও সাহায্য় মেলেনি বলে জানিয়েছেন আওয়ামি লিগের যুগ্ম সম্পাদক ইব্রাহিম শাহিন। 


এমনকি বাংলাদেশি লোকগীতির অতি পরিচিত মুখ রাহুল আনন্দও হামলা থেকে রেহাই পাননি। ‘জলের গান’ ব্যান্ডের সদস্য রাহুলের বাড়িতে হামলা চলে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বাড়িটিতে। বাদ্যযন্ত্র, সব সরঞ্জাম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল মাকরঁও রাহুলের ওই বাড়িতে পা রেখেছিলেন। রাহুল, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। গোপন আশ্রয়ে রয়েছেন তাঁরা। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পী অর্ণব। রাহুলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তিনি।


এই আবহে ব্যতিক্রমী ছবিও সামনে উঠে এসেছে। গাজিপুরে মন্দির-সহ সরকারি দফতরগুলিকে পাহারা দিতে দেখা গিয়েছে আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পর পর যা ঘটছে, তাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বাংলাদেশের হিন্দুরা। ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁদের। পরিস্থিতি বিবেচনা করা ভারতের তরফেও তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে একাধিক রাজ্যে। সেই আবহেই বৃস্পতিবার জলপাইগুড়ির মানিকগঞ্জে সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় ১২০০ বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে ঢোকার চেষ্টা করেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাঁদের আটকে দেয় যদিও। 


এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মহল তো বটেই, বিশিষ্ট জন থেকে তারকা-শিল্পীরাও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বলিউড অভিনেত্রী রবীনা ট্যান্ডন সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘বাংলাদেশে সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনায় আমি বিচলিত। এই ধরনের নির্লজ্জ হামলার সময় ন্যায় বিচার এবং মানবিকতার খাতিরে একজোট হতে হবে আমাদের। পীড়িতদের সমবেদনা জানাই। অবিলম্বে এই হিংসার অবসান ঘটাতে আর্জি জানাচ্ছি’। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এ নিয়ে স্পষ্ট ভাবে কিছু জানানো না হলেও, হিন্দু জনজাগরুতি সমিতির তরফে CAA-র আওতায় বাংলাদেশি হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে।


আরও পড়ুন: Muhammad Yunus: সামান্য ভুলে জয় হাতছাড়া হতে পারে, বাংলাদেশবাসীকে সাবধান করলেন ইউনূস