নয়াদিল্লি: লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে গত বছর ৩০ মে কেন্দ্রে ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। শুরু হয়েছিল "মোদি ২.০" সরকারের পথ চলা।


দ্বিতীয়বার দিল্লির মসনদে বসা ইস্তক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরিষ্কার করে দেন, দেশের প্রতিরক্ষাকে তিনি হাল্কা নেবেন না। প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালীন মোদি বুঝেছিলেন, পূর্ণ-যুদ্ধের চেয়ে ভারতকে অনেক অনেক বেশি মনোনিবেশ করতে হবে সীমান্তপার থেকে আসা আগ্রাসন ও অনুপ্রবেশের মোকাবিলার জন্য। প্রথম মোদি সরকারের আমলেই ঘটে গিয়েছে উরি-পুলওয়ামার মতো ঘটনা। যার জবাবে ভারতকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও এয়ার রেইড-এর মতো পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে।


ফলে, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে মোদি সরকার সেই সব সামরাস্ত্রের ওপর নজর দেন, যার মাধ্য়মে এধরনের অভিযান আরও ক্ষিপ্র, আরও নিখুঁত এবং আরও গোপনে করতে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনা। টিম মোদি বুঝেছিলেন, যুদ্ধবিমান কেনাটা যেমন প্রয়োজনীয়, যেমন দেশের সীমান্ত রক্ষায় এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই অত্যাবশ্যক এধরনের কোভার্ট অভিযানের উপযুক্ত অত্যাধুনিক সামরিক-হেলিকপ্টার এবং সমোপযোগী ট্যাক্টিক্যাল গিয়ারের-- যা দেশের স্পেশাল ফোর্সের কাজে আসবে।


এইসব দিক মাথায় রেখে প্রথম বছরেই বিদেশি সংস্থার সঙ্গে এমন কিছু বড় বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলে দ্বিতীয় মোদি সরকার। এই চুক্তিতে বিশেষ করে নজর দেওয়া হয় ধুঁকতে থাকা সামরিক অস্ত্রভাণ্ডারকে সময়োযোগী, শক্তিশালী ও তার আধুনিকীকরণ করা। এর জন্য একাধিক সংস্কারমূলক, ইতিবাচক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।


এই চুক্তিগুলির ফলে, ভারতের সামরিক শক্তি যে এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকী, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরাও একমত যে, ভারতের এই চুক্তিগুলি বর্তমান সময়ে প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে একটি "গেম চেঞ্জার" প্রমাণিত হবে। কারণ, এর ফলে, পাকিস্তান সীমান্তে ভারত অনেকটাই অ্যাডভান্টেজে থাকবে।


দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই প্রতিরক্ষা ক্রয়কে আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে এই সংক্রান্ত আইন ও নীতিতে বদল আনেন মোদি সরকার। লক্ষ্য ছিল, সর্বাধুনিক সামরাস্ত্র প্রদান করে দেশের প্রতিরক্ষাকে বাহিনীকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী হিসেবে পরিণত করা, যাতে যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতি, বিদেশি আগ্রাসন, ভারতের বিরদ্ধে যুদ্ধের চেষ্টা হলে, বাহিনী তার প্রতিহত করতে সক্ষম ও সমর্থ হয়।


তবে, শুধু কেনা নয়, দ্বিতীয় মোদি সরকার চুক্তির মাধ্যমে সামরাস্ত্র ভারতে প্রস্তুত করার রাস্তাও তৈরি করেন। যে কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল ও রাশিয়ার মতো বিশ্বের প্রথম সারি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রের থেকে "গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট" চুক্তি করে যেমন সরাসরি অস্ত্র কেনা হয়েছে, তেমনই "মেক ইন ইন্ডিয়া"-র ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বে অনেক সামরিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রাংশ এদেশেই তৈরি হয়।


তাই দ্বিতীয় মোদি সরকারের প্রথম বছরে দেশ দেখেছে একাধিক সামরিক চুক্তি-- যার মাধ্যমে সেনার তিন বিভাগকেই আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফ্ট গান। তেমনই রয়েছে অত্যাধুনিক রাইফেল ও লাইট মেশিন গান। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক মোদি ২.০ সরকারের প্রথম বছরে হওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য সামরিক চুক্তি---


১. নৌবাহিনীর জন্য রোমিও ও সেনার জন্য অ্যাপাচে হেলিকপ্টার কিনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৩ বিলিয়ন ডলার চুক্তি


২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি। মোট চুক্তিমূল্য ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার। এর মধ্য়ে ২৪টি "এমএইচ-৬০আর রোমিও" হেলিকপ্টারগুলি নৌসেনার জন্য। এর পাশাপাশি ৬টি "এএইচ-৬ই অ্যাপাচে অ্যাটাক হেলিকপ্টার" কেনা হয় স্থলসেনার জন্য।


আকাশপথে কম উচ্চতায় হামলা ও নজরদারি -- এই দুটিতেই অ্যাপাচে অদ্বিতীয়। মার্কিন সেনায় বহুলভাবে ব্যবহার হয় এই চপার। কার্যক্ষমতার জন্য বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয় এই কপ্টার। রুশ-নির্মিত এমআই-৩৫ হেলিকপ্টারকে স্থানান্তরিত করবে অ্যাপাচে। অন্যদিকে, সমুদ্রে নজরদারি চালাতে নৌবাহিনীর "সি কিং" ফ্লিটের বদলে ব্য়বহার করা হবে রোমিও হেলিকপ্টারগুলি।


২. রাশিয়া থেকে "আর-২৭" এয়ার-টু-এয়ার (এএএম) মিসাইল কিনতে ১,৫০০ কোটি টাকার চুক্তি


২৭ জুলাই রাশিয়া থেকে "আর-২৭" এয়ার-টু-এয়ার (এএএম) মিসাইল কিনতে ১,৫০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ভারতীয় বায়ুসেনা। বিমানবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করতেই এই অত্যাধুনিক এই মিসাইল কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মিসাইলগুলি রুশ-নির্মিত "সুখোই-৩০ এমকেআই" যুদ্ধবিমানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দিনের যে কোনও সময়ে যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই মিসাইল লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম। এই মিসাইল হাতে এলে ভারতীয় বায়ুসেনার শক্তি অনেকটাই বাড়বে বলে অনুমান বিশেষজ্ঞদের।


৩. লাইট মেশিন গান কিনতে ইজরায়েলের সঙ্গে ৮০০ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা চুক্তি


চলতি বছর ১৯ মার্চ ইজরায়েলের সঙ্গে ৮০০ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পন্ন করে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। এই চুক্তি মোতাবেক ইজরায়েল উইপন্স ইন্ডাস্ট্রি ভারতের জন্য ১৬ হাজার ৪৭৯টি "নেগেভ এনজি" লাইট মেশিন গান (এলএমজি) তৈরি করবে। বিশ্বে ভীষণই জনপ্রিয় ২০১২ সালে আত্মপ্রকাশ করা এই এলএমজি।


বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ভারতীয় সেনার পদাতিক বাহিনীর কাছে অতি-গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র প্রমাণিত হবে এই এলএমজি। বিশেষ করে, শত্রু ছাউনি-বাঙ্কারের ওপর হামলা চালাতে এই অস্ত্র অত্যন্ত কার্যকর। নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তর কাছে মোতায়েন জওয়ানদের হাতে তুলে দেওয়া হবে এই অস্ত্র। সেমি অটোম্যাটিক এবং অটোম্যাটিক মোডে ব্যবহার করা যায় এই অস্ত্র। পাশাপাশি ছোঁড়া যায় গ্রেনেডও।


৪. ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী মিসাইল (এটিজিএম) কিনতে ৮৫০০ কোটি টাকার চুক্তি


ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী মিসাইল (এটিজিএম) কিনতে ৮৫০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ভারত। লোকসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফেরার ৫০ দিনের মাথায় "স্পাইস-২০০০" ও "স্ট্রুম আটাকা" এটিজিএম কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত। জরুরি ভিত্তিতে এই সামরাস্ত্র কেনার চুক্তি করে কেন্দ্র। পাশাপাশি, এর বিপুল সংখ্যক স্পেয়ার পার্টসের বরাতও দেওয়া হয়।


৫. দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) নিয়োগ


দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় ফিরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) নিয়োগকে শিলমোহর দেয়। দেশের সামরিক বাহিনীর তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় আনতেই এই নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কৌশল ও নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে সময়োচিত এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সুবিধা হবে।


ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতকে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারতের প্রথম সিডিএস হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। জেনারেল রাওয়াত পুরো তিন বছর মেয়াদ শেষ করে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার ঠিক একদিন আগে তাঁকে চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ মনোনীত হয়েছিলেন।


চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ হিসাবে জেনারেল রাওয়াতের নিয়োগ ঐতিহাসিক। কারণ তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার যিনি চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ পদে অধিষ্ঠিত হন। সরকারের "সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইসর" হিসাবে কাজ করবে সিডিএস এবং সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি বিভাগের মধ্যে আরও ভাল সমন্বয় তৈরির দিকে মনোনিবেশ করবে।


৬. প্রতিরক্ষায় বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের সীমা ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ


দ্বিতীয় মোদি সরকারের স্পষ্ট নীতি হল প্রতিরক্ষা উৎপাদনে স্বনির্ভরতা ও দেশীকরণকে উৎসাহ দেওয়া। তাই প্রতিরক্ষা উৎপাদন ক্ষেত্রে একাধিক পদক্ষেপ ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর 'আত্মনির্ভর ভারত অভিযানকে' সমর্থন জোগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সীমা বৃদ্ধি স্থানীয়ভাবে তৈরি সামরিক হার্ডওয়্যার কেনার জন্য আলাদা বাজেট তৈরি করা এবং আমদানি করা যায় না এমন অস্ত্র / সরঞ্জামের একটি তালিকা।


পাশাপাশি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্মলা সিথারমন গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেছিলেন যে, প্রতিরক্ষা উৎপাদন খাতে (স্বয়ংক্রিয় রুটের আওতাধীন) বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের সীমা ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করা হবে সুরক্ষা ছাড়পত্রের সাপেক্ষে।