নয়াদিল্লি: দুর্নীতির অভিযোগে ফের কাঠগড়ায় শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা আদানি গোষ্ঠী। Organised Crime and Corruption Reporting Preoject (OCCRP)-র তরফে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, তামিলনাড়ুর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাকে নিকৃষ্ট মানের কয়লা পাঠিয়ে, তার তিন গুণ দাম আদায় করেছে আদানি গোষ্ঠী। কোটি কোটি টাকা পকেটে ঢুকেছে তাদের। (Adani Coal Scam Allegations)
তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় যুক্ত সাংবাদিকদের নেটওয়র্ক এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি মালবাহী জাহাজ MC Kalliopi K তামিলনাড়ুর এন্নোর বন্দরে নোঙর করে। ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে যাত্রা করে সেখানো পৌঁছয় জাহাজটি। ওই জাহাজে ৬৯ লক্ষ ৯২৫ টন কয়লা ছিল, যা রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে পৌঁছ দেওয়াই লক্ষ্য ছিল। (OCCRP Adani Report)
বন্দরে জাহাজটি নোঙর করার পর কাগজে সইসাবুদ-সহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে কয়লা তামিলনাড়ু বন্দরে পৌঁছলেও, কাগজের রেকর্ডে আঁকাবাঁকা যাত্রাপথ দেখানো হয়। ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, সেখান থেকে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস হয়ে আঁকাবাঁকা পথে জাহাজটি তামিলনাড়ু পৌঁছেছে বলে জানানো হয়।
ওই দীর্ঘ যাত্রাপথ দেখিয়েই নিকৃষ্ট মানের কয়লার দাম প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে, প্রতি টনে ৯১.৯১ ডলার করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিকৃষ্ট মানের কয়লাকে পরিষ্কার এবং উচ্চমানের কয়লা হিসেবে দেখানো গয়, ঠিক যেমনটি চাহিদা ছিল রাজ্যের বিদ্য়ুৎ সংস্থার। তদন্তকারীদের দাবি, তামিলনাড়ু জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কর্পোরেশনের কাছে কাগজ পৌঁছনোর আগে, এক দালালের হাতে বদলি হয় কাগজপত্র। করফাঁকির স্বর্গরাজ্য ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডেসের সংস্থা Supreme Union Investors Ltd সেই দালালের ভূমিকা পালন করে। ওই সংস্থার তরফে Adani Global PTE Singapore-কে পৃথক বিল তৈরি করে দেওয়া হয়, যাতে প্রতি টন কয়লার দাম ৩৩.৭৫ ডলার লেখা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে ওই কয়লাকে নিকৃষ্ট মানের কয়লা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়, অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ৩৫০০ কিলোক্যালরি। কিন্তু একমাস পর Adani Global তামিলনাড়ু জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কর্পোরেশনকে যে বিল ধরায়, তাতে নাটকীয় ভাবে প্রতি টন কয়লার দাম ৯১.৯১ ডলার ধার্য করা হয়। নিকৃষ্ট মানের ওই কয়লাই একেবারে বিশুদ্ধ, উচ্চমানের হয়ে যায়, প্রতি কেজিতে ৬০০০ কিলোক্যালরি দেখানো হয় সেখানে।
দুর্নীতির প্রমাণস্বরূপ ইন্দোনেশিয়ায় আদানিদের কয়লা সরবরাহ করে যে সংস্থা,, তামিলনাড়ু বন্দর থেকে প্রাপ্ত নথি, ব্যাঙ্কের লেনসংক্রান্ত তথ্য,বিল প্রভূতিকে তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ভারত সরকারের রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ (DRI), যা কি না কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অধীনস্থ, প্রায় একদশক আগে এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল। বিদেশি দালালদের সাহায্যে আদানি গোষ্ঠী কয়লার দাম বাড়িয়ে দেখিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু বম্বে হাইকোর্টে একটি মামলায় জয়ী হয় আদানি গোষ্ঠী, যা DRI-এর কয়লা সরবরাহ, বিল সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দেখতে চাওয়াকে রুখে দেয়। সুপ্রিম কোর্টে সেই নিয়ে আবেদনও জানায় DRI.
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া অলাভজনক সংগঠন Arappor Iyakkam জানিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তামিলনাড়ু সরকার আদানিদের থেকে ২.৪৪ কোটি কয়লা কেনে। সেই সময় যত কয়লা আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে, তার ৪৯ শতাংশই আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নিকৃষ্ট মানের কয়লার ওজনও বেশি হয়। আমদানিকৃত কয়লার গুনমান ৬০০০ কিলোক্যালরি হওয়াই দস্তুর, কিন্তু বাস্তবে তার চেয়ে নিকৃষ্ট মানের কয়লা সরবরাহ করা হয়। ফলে তামিলনাড়ু বিদ্যুৎ বিভাগ বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে। এ নিয়ে এফআইআর দায়ের হয়, ডিরেক্টরেট অফ ভিজিল্যান্স অ্যান্ড অ্যান্টি করাপশন-কেও দুর্নীতির কথা জানানো হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রাক্তন আধিকারিকদের বিরুদ্ধে তল্লাশিও চলে। কিন্তু আদানিদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলে দাবি ওই অলাভজনক সংস্থার।
এ নিয়ে তামিলনাড়ু জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কর্পোরেশনের তরফেও এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছিল। কিন্তু আজও তার রিপোর্ট সামনে আসেনি। ২০২১ সালে তামিলনাড়ুর তৎকালীন বিদ্যুৎমন্ত্রী ভি সেন্থিবালাজি জানান, নর্থ চেন্নাই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২.৩৮ লক্ষ কোটি কয়লা চুরি গিয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। এর প্রেক্ষিতে তামিলনাড়ু জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কর্পোরেশন মেনে নেয় যে, নিকৃষ্ট মানের কয়লাকে উচ্চমানের বলে চালানো হয়েছিল, যাতে কয়লায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
তদন্তে জানা গিয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এমন নিকৃষ্ট মানের কয়লা ২৪টি জাহাজ কয়লা নিয়ে তামিলনাড়ু বন্দরে পৌঁছয় বলে দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে। নিকৃষ্ট মানের ওই কয়লার দাম তিন গুণ বেশি ধার্য করে আদানি গোষ্ঠী।মএই নিম্নমানের কয়লা পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, পরিবেশেরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে বলে মত তদন্তকারীদের। নয়া এই রিপোর্ট সামনে আসার পর নতুন করে জাতীয় রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। কিন্তু আদানিরা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মিথ্যে, ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন আদানি গোষ্ঠীর মুখপাত্র।