ভুবনেশ্বর: ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন, অর্থাৎ SIR ঘিরে রাজনীতির পারদ তুঙ্গে। বাংলা ভাষায় কথা বলার দরুণ বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠছে। আর সেই আবহেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গের পড়শি রাজ্য ওড়িশায়। সেখানে আদিবাসী বনাম বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত চরম আকার ধারণ করল। প্রথমে এক মহিলা নিখোঁজ হয়ে যান সেখানে। পরে তাঁর মুণ্ডহীন দেহ উদ্ধার হয়। সেই নিয়ে অশান্তি ছড়াতে ছড়াতে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। বাঙালি অধ্যুষিত একটি গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠল আদিবাসীদের বিরুদ্ধে। (Malkangiri Unrest)

Continues below advertisement

ওড়িশার মালকানগিরি জেলায় এই ঘটনা ঘটেছে। এই মুহূর্তে সেখানকার পরিস্থিতি থমথমে। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। নামানো হয়েছে বিরাট বাহিনী। শুধু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াই নয়, অনেক গাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ সামনে এসেছে। সোমবার সন্ধে ৬টা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য কার্ফু জারি করা গয়েছে সেখানকার দু’টি গ্রামে। পাঁচজনের বেশি মানুষের জমায়েত একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাস্তায় টহল দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। (Odisha Unrest)

কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাখালগুড়া গ্রামে আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক মহিলা সম্প্রতি নিখোঁজ হয়ে যান। গত ৪ ডিসেম্বর, নদীর ধার থেকে ৫১ বছর বয়সি ওই মহিলার মুণ্ডহীন দেহ উদ্ধার হয়। জমি নিয়ে বিবাদ থেকেই ওই মহিলাকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় শুভরঞ্জন মণ্ডল নামের একজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।

কিন্তু তার পরও বাংলাভাষীদের উপর হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। জানা গিয়েছে MV-26 এলাকায় বসবাসকারী বাংলাভাষীদের উপর হামলা চালানো হয় রবিবার। তির, ধনুক, কুড়ুল, বর্শা নিয়ে বাংলাভাষীদের গ্রামে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৫ হাজার লোকজন মিলে তাণ্ডব চালায় বলে দাবি। কমপক্ষে ১৫০ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে যদিও নীরব স্থানীয় প্রশাসন। পুলিশের উপস্থিতিতেই গোটা গ্রামে তাণ্ডব চালানো হয় বলে অভিযোগ। ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন বহু মানুষ।

মালকানগিরির পুলিশ সুপার বিনোদ পাটিল পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যান। DGP ওয়াই বি খুরানা এবং অন্য আধিকারিকরাও ছুটে যান ঘটাস্থলে। অশান্তির জন্য বাংলাভাষীদের দিকে আঙুল তুলেছেন আদিবাসী নেতা বন্ধু মুড়ুলি। বাংলাভাষীদের জন্য এলাকায় অপরাধ বাড়ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তাঁর দাবি, বৈধ নথিপত্র ছাড়াই বহু বাঙালি ওই গ্রামে বসবাস করছেন। সরকারের দেওয়া ‘গ্রিন কার্ড’ ছাড়া তাঁদের গ্রামে কারও থাকা যাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

যদিও হামলার শিকার বাংলাভাষীদের দাবি, পরিকল্পিত ভাবেই হামলা চালানো হয়েছে তাঁদের উপর। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছেন তাঁরা। জেলাশাসকের দফতরের বাইরে বিক্ষোও দেখান অনেকে। মালকানগিরি বাঙালি সমাজের তরফে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয় জেলাশাসক সোমেশকুমার উপাধ্যায়ের কাছে। বাড়িঘর, সম্পত্তি নষ্ট নিয়ে অভিযোগ জানান। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করেন। 

মালকানগিরি বাঙালি সমাজের সভাপতি গৌরাঙ্গ কর্মকার জানান, অশান্তি বাঁধানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে বার বার স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন তাঁরা। তার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁর বক্তব্য, “কামওয়াড়া পঞ্চায়েতে এর আগে একই ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমরা শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করছিলাম। এবার হিংসা সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।” তাণ্ডবকারীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছে মালকানগিরি বাঙালি সমাজ। পাশাপাশি, ক্ষতিপূরণের দাবিও জানানো হয়েছে।

জেলাশাসক জানিয়েছেন, শান্তি বজায় রাখতে, গুজব আটকাতে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে আপাতত। পরিস্থিতিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। কমিউনিটি কিচেন খলা হয়েছে, অস্থায়ী শিবির গড়া হয়েছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো যায়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করে দেখা হচ্ছে। যে মহিলার দেহ উদ্ধার হয়, তাঁর মুণ্ডটি এখনও মেলেনি। সেটিরও খোঁজ চলছে। নদী বরাবর এলাকায় বসানো হয়েছে ক্যামেরা।

সাতের দশকে এবং তার আগে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা প্রায় ২ লক্ষ বাঙালি পরিবারের বসবাস মালকানগিরি জেলায়। ২১৪টি গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তাঁরা। ভারতের নাগরিকত্বও পেয়েছেন সকলে। ১৯৫৬ সালেও বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়। যে MV-26 এলাকায় হামলা হয়েছে, সেখান থেকে বাড়িঘর ছেড়ে প্রায় ১০০০ মানুষ পালিয়ে গিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। ওই এলাকায় বাঙালিদের পুনর্বাসন দেওয়া নিয়ে বরাবরই আপত্তি আদিবাসীদের। দুই তরফে সংঘাতের ইতিহাসও দীর্ঘ।

বিজু জনতা দলের বিধায়ক রণেন্দ্র প্রতাপ সোয়েইন বলেন, "মালকানগিরি ওড়িশার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ (জীবনের অধিকার), অনুচ্ছেদ ২৫ (ধর্মীয় স্বাধীনতা) এই মুহূর্তে বিপদের মুখে। হিংসা, অগ্নিসংযোগ, লুঠ, খুন বাড়ছে ওড়িশায়। পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট চাওয়া উচিত স্পিকারের।" যদিও বিজেপি বিধায়ক টঙ্কাধর ত্রিপাঠির দাবি, পূর্বতন BJD সরকারের তুলনায়, তাঁদের সরকার পরিস্থিতি সঠিক ভাবেই সামলেছে।