কলকাতা : সহেলি দেব। পাটুলির বাসিন্দা। স্বামীর কর্মসূত্রে এখন চেন্নাইয়ে থাকেন। গরমের ছুটি কাটিয়ে ৭ বছরের ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে ফিরছিলেন করমণ্ডলে। দুর্ঘটনার কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠছেন সহেলি। ছেলেকে নিয়ে ট্রেন থেকেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন এই দম্পতি। কামরা দুলছিল। একজনের ওপর আরেকজন পড়ে আছে। সেই অবস্থা থেকে সপরিবারে বেঁচে ফেরা, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না পাটুলির এই পরিবারের।


সহেলি বলেন, "ট্রেনটা শুরু থেকে সঠিক সময়ে যাচ্ছিল। আমরা ঠিকঠাক কন্ডিশনে ছিলাম। আমি সাইড আপারে ছিলাম। বালেশ্বর ক্রস করতেই দেখলাম একটা জোর জার্কিং হল। যে জার্কিংয়ে আমরা ভেবেছিলাম এমার্জেন্সি ব্রেক। কিন্তু, দেখলাম জার্কিংটা বন্ধ হচ্ছেই না। স্টেপ বাই স্টেপ ধাক্কা খেতেই থাকছি। ধীরে ধীরে আমার কম্পার্টমেন্টটা একদিকে হেলে যাচ্ছিল। নীচে যারা বসেছিল, একজনের ওপর আর একজন পড়ে যাচ্ছিল। জিনিসপত্র হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে। তখন বুঝতে পারলাম, আমাদের ট্রেনটা গুরুতর দুর্ঘটনার মুখে পড়তে চলেছে। আমরা আর বাঁচব না। সেই পরিস্থিতিতে হঠাৎ দেখলাম ট্রেনটা থেমে গেল। তখন হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই অবস্থায় আমি, আমার স্বামী ও ছেলে লাগেজ নিয়ে ঝাঁপ দিলাম। ভিড়ের মধ্যে ছেলের হাত চেপে ধরেছিলাম।" 


মালগাড়ির ওপর করমণ্ডলের ইঞ্জিন। দেশলাই বাক্সের মতো দুমড়ে মুচড়ে গেছে কামরা। বালেশ্বর ট্রেন দুর্ঘটনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। দুর্ঘটনার পর থেকে উদ্ধার হচ্ছে পরপর মৃতদেহ।


কেউ কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। কেউ বাড়ি থেকে যাচ্ছিলেন কাজে। কেউ আবার বাড়ি থেকে ফের রওনা দিয়েছিলেন কর্মস্থলের উদ্দেশে। কিন্তু মাঝপথেই ওলট-পালট হয়ে যায় সব হিসেব। ধেয়ে আসে মৃত্যুর হাতছানি। চারদিকে শুধু মৃতদেহ আর কান্নার রোল। সেই বিভিষিকার মধ্যেও, কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন কেউ কেউ। পাটুলির দম্পতিও সেই ভাগ্যবানদের তালিকায় রয়েছে।


বালেশ্বরে দুর্ঘটনার কবলে পড়া, যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসের একটি জেনারেল বগির একমাত্র জীবিত যাত্রী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়!
বাঁকুড়ার জয়পুরের বাসিন্দা সুরজিৎ ব্যাঙ্গালোরের বেসরকারি কলেজের নার্সিং কোর্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ব্য়াঙ্গালোরের SMVT থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন। নামার কথা ছিল খড়গপুরে। তার আগেই শুক্রবার সন্ধেয় ঘটে যায় সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। কিন্তু, বগির মধ্যে একমাত্র তিনি যেভাবে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন, তা যেন পুনর্জন্ম! সুরজিৎ বলেন, 'একমাত্র আমার বগিতে আমিই বেঁচে আছি। আর কেউ নেই।'


সুরজিতের মতো কোনওরকমে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন, চেন্নাইয়ের বাসিন্দা অনুজা বারিক ও তাঁর পরিবার। মাথায় গুরুতর চোট পেয়েছেন। কিন্তু, চোখের সামনে যা দেখেছেন, তা এককথায় বিভীষিকা ! 


পিকনিক গার্ডেনের বাসিন্দা সায়ন্তনী ঘোষ। বাপের বাড়িতে ১১ বছরের মেয়ের জন্মদিন পালন করে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চড়ে চেন্নাইয়ে স্বামীর কাছে ফিরছিলেন। শুক্রবার বালেশ্বরে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন মা-মেয়ে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা। সায়ন্তনী বলেন, চোখ বন্ধ করলেই সেই দৃশ্যটা সামনে আসছে, ট্রমাটাইজ হয়ে আছি। A1 কামরায় সন্ধেবেলায় লোয়ার সিটে বসেছিলাম। মারাত্মক ঝাঁকুনি...ছিটকে একদিকের সিট থেকে অন্যদিকের সিটে। কাচ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম আগুনের ফুলকি, বুঝতে পারি ট্রেন ডিরেল হয়েছে। ঘাড়ে কোমরে প্রত্য়েকে চোট পেয়েছি, সর্বাঙ্গে যন্ত্রণা। 


সায়ন্তনীদের ট্রেনেই ছিলেন, বেগুসরাইয়ের বাসিন্দা এই হায়দার আলি। আরও ৬জনকে নিয়ে চেন্নাইয়ে কাজে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তিনজন প্রাণে বাঁচলেও, বাকিদের খোঁজ পাননি।


শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে চেন্নাই যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর বাসিন্দা পারুল মোল্লা। শ্বশুর-বৌমা, দুজনেই জখম হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তাঁরা। তবুও প্রাণ নিয়ে তো ফিরে আসা গেছে। এটাই এখন তাঁদের কাছে জীবনের বড় পাওয়া।