বেইরুট: প্রত্যেকের হাতে ফোন ওঠেনি তখনও। তৎক্ষণাৎ যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পেজার। সংক্ষিপ্ত বার্তা পৌঁছে দেওয়া যেত লিখে। সময়ের সঙ্গে বিস্মৃত হতে বসা সেই পেজারই এবার খবরের শিরোনামে উঠে এল। কারণ এবার নিধনযজ্ঞের হাতিয়ার হয়ে উঠল সেটি। লেবাননে ওই পেজার বিস্ফোরণে ন'জন মারা গিয়েছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০০। ইজরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। (Lebanon Pager Explosion)


ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হেজবোল্লা। হেজবোল্লার সদস্যরা কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে এখনও পেজার ব্যবহার করে, যাতে লোকেশন বঝা যায় না।  মঙ্গলবার একসঙ্গে ৩০০০ পেজারে বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। (Israel-Gaza War)


এই হামলায় ইজরায়েলে মোতায়েন থাকা ইরানের রাষ্ট্রদূত মোদতবা আমানিও আহত হয়েছেন। লেবাননের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিরাস আবিয়াদ জানিয়েছেন, কমপক্ষে ন'জন পেজার বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন। আহতের সংখ্যা ৩০০০-এর কাছাকাছি, যাঁদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন ২০০ জন। 



লেবাননের বেকা উপত্যকায় হেজবোল্লার এক সদস্যের ১০ বছরের কন্যাও পেজার বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন। পাশাপাশি, সিরিয়াতেও পেজার বিস্ফোরণে ১৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সেখানে পেজার ব্যবহার করে একটি গাড়িও উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। বিস্ফোরণের ফলে মুখ, হাত এবং পেটে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হেজবোল্লাকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু তাদের প্রতি সমর্থন রয়েছে ইরানের। হেজবোল্লা আবার প্যালেস্তাইনের হামাসকে সমর্থন করে। ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধে তারা ইজরায়েলের প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে। 


আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পেজারে ব্যবহৃত লিথিয়ামকে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করা হয়েছে। সাইবার হামলার আদলে প্রথমে ইলেকট্রনিক সিগনাল বিঘ্নিত হয় এবং তার পরই ব্যাটারি তেতে উঠে বিস্ফোরণ ঘটে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। যদিও বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, সামান্য পরিমাণ বিস্ফোরক আগে থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল পেজারগুলিতে। পরিকল্পনা মাফিকই হামলা চালানো হয়েছে।


এই ঘটনাক জন্য সরাসরি ইজরায়েলের দিকে আঙুল তুলেছে হেজবোল্লা। এযাবৎকালীন সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা লঙ্ঘন বলেও এই ঘটনাকে উল্লেখ করেছে তারা। তাদের দাবি, একসঙ্গে ৩০০০ পেজারে বিস্ফোরণ ঘটে। ইজরায়েল তাদের যোগাযোগের মাধ্যমকেই হাতিয়ারে পরিণত করেছে বলে দাবি তাদের। ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধ চলাকালীন, হেজবোল্লার সঙ্গেও তাদের সংঘাত দেখা গিয়েছে। পরস্পরকে লক্ষ্য করে রকেট, ড্রোন ছুড়েছে তারা। তাদের এক নেতা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, লেবাননের দক্ষিণে এবং বেউরুটের দক্ষিণের শহরতলিতে হেজবোল্লার সদস্যরা বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে লেবানন সরকারও। 


হেজবোল্লার তরফে বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, পেজার বিস্ফোরণ পরিকল্পিত এবং এর জন্য ইজরায়েলই সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী। এক শিশুকন্যা এবং তার দুই ভাইও মারা গিয়েছে। সংগঠনের অন্দরে তদন্ত শুরু হয়েছে। একসঙ্গে এতগুলি পেজারে বিস্ফোরণ ঘটল কী করে, দেখা হচ্ছে খতিয়ে। সদস্যদের পেজার ব্যবহার নিয়েও সতর্ক করেছে তারা। ইজরায়েল এবার মানসিক যুদ্ধে নেমেছে, মনোবল ভেঙে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য বলে দাবি করেছে হেজবোল্লা। ইজরায়েল এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। 


যে পেজারগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলি তাইওয়ানের Gold Apollo সংস্থার তৈরি বলেও খবর উঠে আসে। যদিও তাইওয়ানের ওই সংস্থা জানিয়েছে, তাদের তৈরি পেজারে বিস্ফোরণ ঘটেনি। যেগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলি ইউরোপের BAC সংস্থার তৈরি। তাইওয়ানের ব্র্যান্ড ব্যবহার করার অনুমোদন রয়েছে তাদের কাছে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সু চিং-কুয়াং জানিয়েছেন, ওই পেজার তাঁদের তৈরি নয়, শুধু তাদের ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করা হয়।


ইউরোপীয় সংস্থাটির অবস্থান খোলসা করেননি সু। তবে তিনি বলেন, "আমরা বড় সংস্থা নই যদিও, কিন্তু আমরা দায়িত্বশীল। এই ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক।" পেজারগুলির মাধ্যমে কী করে বিস্ফোরণ ঘটানো হল, তাতে বিস্ফোরক ঢোকানো হল কী করে, কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন সু। এই ঘটনায় তাইপেই-তে ইতিমধ্যেই তাঁদের সংস্থায় পুলিশ এসে পৌঁছেছে। 


হেজবোল্লার তরফে তাইওয়ানের ওই সংস্থায় ৫০০০ পেজারের বরাত দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ওই পেজারগুলির মডেল ছিল AP924. যে পেজারগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার পিছনের অংশে Gold Apollo-র লোগো ছিল। কিন্তু Gold Apollo-র দাবি, BAC-ই সেগুলি তৈরি এবং বিক্রি করে। 


বিভিন্ন সংস্থার তরফে যে  দাবি উঠে আসছে, সেই অনুযায়ী, ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা Mossad ওই পেজারগুলিতে তিন গ্রাম করে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। পেজারের নকশায় বদল ঘটায় তারা। ভিতরে একটি বোর্ড ঢুকিয়ে দেয়, যার মধ্যে বিস্ফোরক পদার্থ রেখে দেওয়া হয়। ওই বোর্ড থেকে সরাসরি Mossad-এর কাছে সঙ্কেত চলে যেত। এত সূক্ষ্ম ভাবে বিস্ফোরক ঢোকানো হয়েছিল যে স্ক্যানারেও তা ধরা পড়েনি। মঙ্গলবার সেই মতোই সঙ্কেত চলে যায় Mossad-এর কাছে। এর পরই একসঙ্গে ৩০০০ পেজারে বিস্ফোরণ ঘটে। পেজারগুলি কয়েক মাস আগেই হেজবোল্লার হাতে এসে পৌঁছেছিল। এই হামলার প্রতিশোধ নেওয়া হবে বলে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে ইজরায়েল।