সুদীপ্ত আচার্য, কলকাতা : সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের শেয়ার করা ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বিতর্ক। ১৯৭১-এ বর্ধমানের আহ্লাদিপুরে ৪ সিপিএম কর্মী খুনের অভিযোগে কংগ্রেসকে দায়ী করে ওই পোস্ট।  অনেক তিক্ততা আছে। একসঙ্গে লড়ছি যখন, তখন এই পোস্টের কী প্রয়োজন? প্রশ্ন কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের। ধর্মনিরপেক্ষতার সূত্রে জোট। তা বলে ৭০, ৭২-এর কথা ভুলে যেতে হবে নাকি! পাল্টা বিকাশরঞ্জন।


এবারের বিধানসভা ভোটে বাম-কংগ্রেসের মার্কশিট শূন্য। খাতায়-কলমে বঙ্গ রাজনীতিতে দুই দলের অস্তিত্ব, স্রেফ কয়েক শতাংশ ভোটে সীমাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে কী হবে জোটের ভবিষ্যত? এই জল্পনার মধ্যেই সোশাল মিডিয়ায় কার্যত যুদ্ধ বেধেছে দু’দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নেপথ্যে সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের শেয়ার করা এক ফেসবুক পোস্ট।


এই পোস্টে সত্তরের দশকে, অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রায়নার আহ্লাদিপুরের একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে ছত্রে ছত্রে আক্রমণ করা হয়েছে কংগ্রেসকে। পোস্টটিতে লেখা হয়েছে, 'ইশু চৌধুরীর নেতৃত্বে কংগ্রেসি গুন্ডারা চাঁদুর খোঁজে গ্রাম আক্রমণ করল, কংগ্রেসি গুন্ডাদের হাতে বন্দুক, আরেকদিকে নিরীহ গ্রামবাসী।'  ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ, বর্ধমান জেলার আহ্লাদিপুরে ৪ সিপিএম কর্মীকে খুনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার জন্য কংগ্রেসের তৎকালীন নেতা নব সাঁই-সহ অন্যদের দায়ী করা হয়।  বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের পোস্টে লেখা, 'ওমর আলির বয়স্ক বাবাকে মারধর করল নব সাঁইয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসি গুন্ডারা, লালচাঁদের পায়ে গুলি করা হয়েছিল, রক্ত রক্ত রক্তে ভেসে গেল গোটা আহ্লাদিপুর গ্রাম।'


এর আগে ১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ বর্ধমানের তেলমারুইপাড়ার সাঁইবাড়িতে খুন হন দুই ভাই মলয় সাঁই ও প্রণব সাঁই এবং গৃহশিক্ষক জীতেন রায়। নাম জড়ায় সিপিএম নেতাদের৷ যদিও সেদিনের ঘটনার জন্য সাঁই পরিবারের প্রতি জনরোষকেই দায়ী করা হয় এই পোস্টে। যেখানে লেখা, 'সাঁইদের ছোড়া বোমার আঘাতে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন গৌর সরকার, পরে এই গৌর সরকারকে পুলিশ গ্রেফতার করে, বোমার ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সাঁইবাড়িতে হামলা চালায়, মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই ও জীতেন রায় মারা যায়, সেদিন বাড়ির জামাই বা নব সাঁইয়ের কিছু হয়নি।' পোস্টে এও দাবি করা হয়, আহ্লাদিপুরে হামলা চালাতে গিয়েই খুন হন কংগ্রেস নেতা নব সাঁই। বিকাশবাবু লেখেন, 'এই নব সাঁই খুন হলে ১২ জুন রায়নার আহ্লাদিপুর গ্রাম আক্রমণ করতে গিয়ে।'


 


 


 


যথারীতি ৫০ বছর আগেকার ইস্যুতে সোশাল মিডিয়া সরগরম! বিতর্কের আবহে এনিয়ে ব্যাখ্যা দেন সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। সিপিএম-র রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, 'ওই সময় সন্ত্রাসে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের স্মরণসভা প্রতি বছর হয়, এবছরও সেই পোস্ট করেছি, যারা দক্ষিণপন্থী তারা কমিউনিস্ট আর কংগ্রেসের যে জোট, তার ক্ষতি করার জন্য বিষয়টি সামনে আনছে।'


গতবছর এ রাজ্য থেকে কংগ্রেসের সমর্থনে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁর কাছ থেকে এই ধরনের পোস্ট যে গ্রহণযোগ্য নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের  সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, 'যখন আমরা একসঙ্গে লড়াই করছি, তখন এই পোস্টের কী প্রয়োজন? আমাদের মধ্যেও অনেক তিক্ততা আছে, আমাদেরও অনেক কর্মী খুনের বিষয় ঘটেছে, কিন্তু আমরা এই বিষয় নিয়ে বলছি না, নিজেদের মধ্যে এধরনের পোস্ট অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করে, এই ধরনের পোস্ট করা থেকে বিরত থাকুন, না হলে আপনারাই অসুবিধায় পড়বেন।'


পাল্টা যুক্তি খাড়া করেছেন সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। সিপিএম-র রাজ্যসভার সাংসদের সংযোজন, 'কংগ্রেসের সঙ্গে যে ঐক্য হয়েছে, তার স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্য, তার মানে এই নয় যে ৭০, ৭২ বা ৭৫ সালে যা হয়েছে, তা ভুলে যেতে হবে, ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে হবে, সেই সময় কংগ্রেসে পচা গলা যারা ছিল, তারা এখন নেই, আজ যারা আছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লড়ছেন, সেই সূত্রেই আমাদের জোট।'


বিতর্ক যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, তাতে অনেকেই বাম ও কংগ্রেসের জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। যদিও দু’দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে এব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।


এবারের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে আইএসএফকে সঙ্গে নিয়ে বাম, কংগ্রেস তৈরি করেছিল জোট। বিধানসভার আসন ভাগাভাগির সময় বারবার অবশ্য কংগ্রেস ও আইএসএফের মধ্যে মতবিরোধ সামনে এসে গিয়েছিল। পরে ভোটের ফলাফলের পর বাম ও কংগ্রেস দুই দলই আসনশূন্য হওয়ায় আড়ালে আবডালে জোট সমীকরণ নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছিল। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও জোটসঙ্গী হিসেবে লড়াই করেছিল বাং-কংগ্রেস শিবির। যদিও ২০১৯-র লোকসভা ভোটে জোট ছিল না। এবারে ফের একসঙ্গে লড়লেও ভোটবাক্সে দেখা যায়নি ইতিবাচক কোনও প্রভাব। এর মাঝেই আবার তৈরি হল নতুন বিতর্ক। জোটের ভবিষ্যতে এই বিতর্কের কোনও রেশ পড়ে কি না, আপাতত সেটাই দেখার।