নয়াদিল্লি: আর কোনও রাখঢাক নয়। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরাসরি ভোট লুঠের অভিযোগ তুললেন কংগ্রেস সাংসদ তথা লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গাঁধী। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে, নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ব্যাপক ভোট লুঠ হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন তিনি। ভোট চুরি নিয়ে তাঁর হাতে ‘পরমাণু বোমা’ রয়েছে বলে গত সপ্তাহেই ঘোষণা করেছিলেন রাহুল। কী প্রমাণ রয়েছে, তা খোলসা না করলেও, বৃহস্পতিবার একাধিক তথ্য তুলে ধরেন রাহুল। (Election Commission)
বৃহস্পতিবার দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাহুল। সেখানে তিনি বলেন, “বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে আঁতাত তৈরি হয়েছে।” একাধিক কেন্দ্রে ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটার, ভুয়ো ঠিকানা যুক্ত করা হয়েছে বলে নথিপত্র তুলে ধরেন তিনি। ছ’মাস ধরে ওই সব তথ্য জোগাড় করা হয়েছে বলে জানান। এদিন শুধুমাত্র বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা কেন্দ্র এবং মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্রের তথ্য তুলে ধরেন রাহুল। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের তথ্য পেশ করেন। (Rahul Gandhi)
রাহুল জানান, খাতায়কলমে ওই লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস মোট ৬ লক্ষ ২৬ হাজার ২০৮টি ভোট পেয়েছে। বিজেপি ভোট পেয়েছে ৬ লক্ষ ৫৮ হাজার ৯১৫টি। অর্থাৎ দুই দলের মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের ব্য়বধান ৩২ হাজার ৭০৭। ওই লোকসভা আসনের অন্তর্গত সাতটির মধ্যে ছয়টিতে কংগ্রেস জিতলেও, মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্রে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ভোটে পরাজিত হতে হয়। রাহুলের দাবি, ওই বিধানসভা কেন্দ্রে ১ লক্ষ ২৫০টি ‘ভোট চুরি’ হয়, যার মধ্যে ১১ হাজার ৯৬৫ ডুপ্লিকেট ভোটার রয়েছে। ৪০ হাজার ৯ জন ভোটারের ঠিকানা ভুয়ো, কিছু ক্ষেত্রে ওই ঠিকানার অস্তিত্বই নেই। ১০ হাজার ৪৫২ জন ভোটারের ঠিকানা হুবহু এক। ৪ হাজার ১৩২ জন ভোটারের ছবিই বৈধ নয়। ৩৩ হাজার ৬৯২ জন ভোটার ফর্ম ৬-এর অপব্যবহার করেছেন।
রাহুলের দাবি, শুধুমাত্র কর্নাটকেই নয়, গোটা দেশে এই প্রক্রিয়ায় ‘ভোট চুরি’ হচ্ছে। অপরাধ ঘটানো হচ্ছে ভারতের সংবিধান, ভারতের জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে। নির্বাচনকে রক্ষা করাই নির্বাচন কমিশনের কাজ, ‘ভোট চুরি’ করা নয় বলেও স্মরণ করিয়ে দেন রাহুল। তিনি জানান, সামান্য ভোটের ব্যবধানে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ক্ষমতায় আসতে মাত্র ২৫টি আসন ‘চুরি’ করতে হতো। লোকসভা নির্বাচনে ওই ২৫টি আসনই বিজেপি জেতে ৩৩ হাজারেরও কম ভোটে।
এদিন রাহুল বলেন, “দেশের সংবিধান অনুযায়ী, এক ব্যক্তি একটি ভোটই দিতে পারেন। কিন্তু সঠিক ভোটারকে ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে কি? ভুয়ো ভোটার যুক্ত করা হচ্ছে কি? ভোটার তালিকা আসল না, আসল নয়? বেশ কিছু সময় ধরেই সন্দেহ মাথাচাড়া দিচ্ছিল। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের জন্যই অ্যান্টি ইনকামবেন্সির সমস্যা তৈরি হয়। একমাত্র বিজেপি-র ক্ষেত্রেই তা দেখা যায় না। বুথফেরত সমীক্ষাও মেলে না, মেলে না অভ্যন্তরীণ সমীক্ষাও। আগে প্রযুক্তির ব্যবহার কম ছিল। একই দিনে গোটা দেশ ভোট হতো। আজকাল মাসের পর মাস ধরে নির্বাচন সাজানো হচ্ছে, দফায় দফায় ভোট হচ্ছে। আমাদের মনেও সন্দেহ দানা বাধছিল। নিশ্চিত হলাম মহারাষ্ট্রকে দেখে। সেখানে পাঁচ মাসে এক সংখ্যক ভোটার যুক্ত করা হয়, যা গত পাঁচ বছরের তুলনায় বেশি। জনসংখ্যার চেয়ে বেশি ভোটার দেখে চমকে উঠেছলাম। বিকেল পাঁচটার পর ভোটদানের হারও বেড়ে যায় অস্বাভাবিক ভাবে। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে ১ কোটির বেশি ভোটার যুক্ত করা হয়, যা নিয়ে সদুত্তর মেলেনি। মেশিনে পাঠযোগ্য় ভোটার তালিকা না দেওয়া, সিসিটিভি ফুটেজ না দেওয়ার জন্য আইন পাল্টে দেওয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ভোট চুরিতে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নির্বাচন কমিশন।” এমনকি গোটা দেশে ‘ভোট চুরি’র প্রমাণও মুছে ফেলা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন রাহুল। তাঁর দাবি, ভোটার তালিকা দেশের সম্পত্তি। কিন্তু সেই তালিকা দিচ্ছে না কমিশন।
রাহুল জানিয়েছে, ‘ভোট চুরি’ হচ্ছে বলে ২০২৩ সাল থেকেই তাঁদের মনে সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল। ২০২৪ সালের মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে পেয়েছে কগ্রেস। কর্নাটকের মহাদেবপুরাতেই শুধুমাত্র ১ লক্ষের বেশি ভুয়ো এবং অস্তিত্বহীন ঠিকানা যোগ করা হয়। রাহুলের কথায়, “আমি একজন রাজনীতিক। মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, এটাকে শপথ হিসেবে গ্রহণ করুন। রাহুল গাঁধী ভুল, এটা কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলেনি।” রাহুল জানান, নির্বাচন সংক্রান্ত গত ১০-১৫ বছরের তথ্য, সিসিটিভি ফুটেজ, যা মেশিনের সাহায্য়ে পড়া সম্ভব, তা যদি নির্বাচন কমিশন না দেয়, বুঝতে হবে, তারাও এই অপরাধে শামিল। ভোটচুরির এই খেলা রুখতে হলে বিচারব্যবস্থাকেও সক্রিয় হতে হবে বলে মন্তব্য করেন রাহুল। তিনি বলেন, “বিচারব্যবস্থাকে অবশ্যই যুক্ত হতে হবে। কারণ আমরা যে গণতন্ত্রকে ভালবাসি, তার অস্তিত্ব নেই। নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্র বাঁচানোর কাজ আর করছেন না, গণতন্ত্র উপড়ে ফেলার কাজ করছেন। আম্পায়ার অন্য দলে শামিল রয়েছেন।”
‘ভোট চুরি’ নিয়ে যে যে অনিয়মের কথা তুলে ধরেছেন রাহুল, সেগুলি হল-
- ভোটার তালিকায় একই ভোটারের নাম একাধিক বার রয়েছে।
- একাধিক রাজ্যে ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে একজন ভোটারের।
- হয় ঠিকানার অস্তিত্বই নেই, নয়ত ঠিকানার জায়গায় ‘০’ লেখা রয়েছে।
- বহু ভোটারের একটিই ঠিকানা দেখানো হয়েছে।
- এত ছোট ছবি লাগানো হয়েছে, এমন ঝাপসা ছবি লাগানো হয়েছে, যাতে ভোটার চেনার উপায় নেই।
- প্রথম বার ভোট দিতে নাম তুলেছেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে ফর্ম ৬-এর অপব্যবহার হয়েছে।
রাহুলের এই মন্তব্যের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। রাহুলকে তিরস্কার করে তারা বলে, “অনিয়ম পেয়েছেন বলে শপথবাক্য পাঠ করুন রাহুল গাঁধী, নয়ত নিজের দেওয়া ভুয়ো প্রমাণ তুলে নিন।” কমিশনের দাবি, সকলেই জানেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটার তালিকা তৈরি হয়। আর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন থাকলে, আদালতে মামলার নিরিখেই একমাত্র প্রশ্ন তোলা যায়। রাহুল যে অভিযোগ করছেন, তাতে বিহারে SIR-এর সিদ্ধান্তের দিকেই সমর্থন যাচ্ছে। বিজেপি-র তরফেও রাহুলের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলা হয়।