সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে আমরা সরস্বতী পুজো করে থাকি। মূলত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ যেসব বাড়িতে পড়ুয়া আছে তাঁরা প্রত্যেকেই সরস্বতী পুজো করেন। আপাতভাবে দেখলে মনে হতে পারে সরস্বতী হলেন বিদ্যার দেবী। কিন্তু তিনি কি শুধুই বিদ্যার দেবী? দেবী ভাগবত অনুসারে সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার পত্নী। তিনি বাক্ দান করেন। তাই তিনি বাগদেবী। তাঁর অপর নাম বাণী বা ভারতী। তিনি ভাষা থেকে শুরু করে সব বিদ্যা দান করেন।
পঞ্জিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে দিনটি শ্রীপঞ্চমী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা জানি ‘শ্রী’হল লক্ষ্মী দেবীর অপর নাম। লক্ষ্মীদেবী ধন-সম্পদের দেবতা নন। ধনদেবতা কুবের। লক্ষ্মীদেবী জীবনের লক্ষ্য স্থির করে জীবনকে শ্রীমন্ত করে তোলেন। সরস্বতীর আশীর্বাদে বিদ্যালাভ যাতে জীবনকে শ্রীমন্ডিত করে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে দেয় তাই সরস্বতীর হাতে যবের শিস দিয়ে তাতে লক্ষ্মীত্ত্ব অর্পণ করা হয়। তাই দিনটি শ্রীপঞ্চমী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই বিষ্ণুর পত্নী।
দ্বিতীয় মহাবিদ্যা তারা দেবীর অপর নাম হল নীল সরস্বতী। তাই তন্ত্রসাধকদের কাছে নীল সরস্বতী পুজো হল তন্ত্রসাধনার মহোৎসব। দুর্গা পুজোর সময় আমরা যে শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ করে বা শুনে থাকি সেখানে দুর্গার কোন উল্লেখ নেই। সেখানে যে তিন দেবীর উল্লেখ রয়েছে তাঁরা হলেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী এবং মহাসরস্বতী। বাংলা বাদে বাকি ভারতের সর্বত্রই এই মহাসরস্বতীর পুজো হয়। তিনি চতুর্ভূজা এবং ত্রিনেত্র। একমাত্র বাংলাতেই দ্বিভূজা সরস্বতীর রূপটি বহুল প্রচলিত। সরস্বতীর বর্ণনায় আমরা দেখি তাঁর গায়ের রঙ কুন্দ ফুল, চাঁদ এবং তুষারের মতন শ্বেতশুভ্র। তাঁর পরনে সাদা শাড়ি। তিনি শ্বেতপদ্মাসনা, শ্বেত পুষ্পশোভিতা, শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা। তিনি যেসব অলঙ্কার পরে রয়েছেন তারও রং সাদা। পুরাণবিদ শিবশংকর ভারতীর মতে সরস্বতী হলেন শুচিতার প্রতীক। জ্ঞান হল নিরাকার এবং জ্যোতির্ময়। আবার জ্ঞানই হল পরম ব্রহ্ম। তাই সবকিছুই রং বিহীন, শুধুই সাদা। তাঁর চার হাতের একটিতে অক্ষমালা, একটিতে বীণা, একটিতে বই এবং আরেকটি হাতে তিনি আশীর্বাদ করছেন। সরস্বতীর বাহন হিসেবে ময়ূর এবং হাঁস দুটোই বহুল প্রচলিত। ময়ূর হল সৌন্দর্যর প্রতীক আর হাঁস হল সেই পরমহংস যে কিনা দুধ এবং জল মিশিয়ে দিলে তার মধ্যে থেকে দুধটুকু আলাদা করে পান করতে পারে। অর্থাৎ জ্ঞান থেকে সার তত্ত্বটি আয়ত্ত করতে পারে।
এসবই হল পৌরাণিক সরস্বতীর কথা। এত কিছু বাদ দিয়ে যদি শুধুই ‘সরস্বতী’ শব্দের বিশ্লেষণ করি দেখা যাবে ‘সরস্বান্’ শব্দের সঙ্গে ‘স্বতী’ স্ত্রীবাচক যুক্ত হয়ে ‘সরস্বতী’ শব্দের উৎপত্তি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসারে যার অর্থ- প্রচুর জলযুক্ত, সমুদ্র, নদ, নদী বিশেষ। ঋগ্বেদে অধিকাংশ জায়গায় ‘সরস্বতী’ শব্দ সিন্ধু নদ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘দেবনদী’ হিসেবেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ যিনি সরস ভাবে বহমান তিনিই সরস্বতী। প্রকারান্তরে তিনি হলেন জলের দেবী। এই সরস্বতী হলেন বৈদিক দেবী, যিনি নদী রূপা। তিনি লুকিয়ে থাকেন- তাই তিনি ফল্গু। প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে তাই গঙ্গা-যমুনা কে দেখা গেলেও সেখানে সরস্বতী কে চোখে পড়ে না।