পুনে: করোনা অতিমারীতে সব থেকে দ্রুত বেড়েছে সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস পুনাওয়ালার সম্পত্তি। ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক পুনাওয়ালার সম্পত্তি বৃদ্ধি বিশ্বে পঞ্চম। অর্থের নিরিখে তিনি বিশ্বের ৮৬তম ধনী ব্যক্তি, ৫৭টি ধাপ এক লাফে উঠে এসেছেন। করোনার প্রথম চার মাসে তাঁর সম্পত্তি বেড়েছে ২৫ শতাংশ।


৭৯ বছরের সাইরাস পুনাওয়ালা ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া। প্রতি বছর সিরাম ইনস্টিটিুট তৈরি করে ১৩০ কোটি টিকা। টিবির টিকা টিউবারভ্যাক, পোলিওর টিকা পোলিওভ্যাক সহ নানা টিকা এই সংস্থা প্রস্তুত করে। ২০০৯-এ তারা তৈরি করেছে সোয়াইন ফ্লু টিকা, ২০১৬-য় আমেরিকার মাস বায়োলজিক্স অফ ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অ্যান্টি র‌্যাবিস টিকা র‌্যাবিশিল্ড। ২০১২ সালে নেদারল্যান্ডসের বিল্ঠোফেন বায়োলজিক্যালস সংস্থাটি তারা অধিগ্রহণ করে, এ বছরের এপ্রিলে অধিগ্রহণ করেছে মার্কিন সংস্থা ন্যানোথেরাপিউটিক্স ইনকর্পোরেটেডের চেক শাখা।

এবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে জুটি বেঁধে সিরাম তৈরি করছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা টিকা কোভিশিল্ড। ভারত এবং অন্যান্য মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলির জন্য তারা ১০ কোটি টিকা তৈরি করবে। শোনা যাচ্ছে, টিকা প্রতি দাম রাখা হবে ২২৫ টাকা।

পুনাওয়ালারা জাতে পার্সি, সাইরাসকে এ দেশের পার্সিরা অনুরোধ করেন, তাঁদের ছোট্ট সমাজের জন্য কিছু করোনা টিকা তুলে রাখতে। পার্সি জাংশন নামে একটি নিউজলেটার সূত্রে খবর, বম্বে পার্সি পঞ্চায়েত চেয়ারম্যান দীনশ রুসি মেহতা হোয়াটসঅ্যাপে সাইরাসকে অনুরোধ করেন, প্রথম ব্যাচে যত টিকা তৈরি হবে তার অন্তত ৬০,০০০ পার্সিদের জন্য রেখে দিতে। এই মুহূর্তে এই কজন পার্সিই ভারতে আছেন, ৪০ জনের আবার করোনায় মৃত্যু হয়েছে।

সাইরাসের ছেলে ও সিরামের সিইও আদার পুনাওয়ালা টুইট করে জানান, প্রয়োজনের থেকে বেশি টিকা পার্সিদের জন্য রাখবেন তাঁরা। পৃথিবীতে তাঁদের সমাজের লোকের সংখ্যা হাতে গোনা, একদিনে তাঁরা যত টিকা তৈরি করেন, তাই পৃথিবীর সমস্ত পার্সিকে নিরাপদ রাখার জন্য যথেষ্ট।

ঠিক হয়েছে, প্রাথমিকভাবে  মাসে ৭ কোটি টিকা তৈরি করবে সিরাম, সংখ্যাটা বেড়ে ক্রমে ১০ কোটি প্রতি মাস হবে।

সাইরাসের ছেলে আদার পুনাওয়ালা ২০০১ সালে সিরামে যোগ দেন। তিনি জানিয়েছেন, তখন তাঁরা ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, ৩০-৪০টার বেশি দেশে তাঁদের টিকা রফতানি হত না। তিনি বোঝেন, এটাই বৃদ্ধির উপযুক্ত সময়, প্রতি ২-৩ বছর অন্তর তাঁরা বার করতে থাকেন নতুন নতুন টিকা আর ওষুধপত্র। এরপর থেকে কোম্পানির রফতানি বাড়ে হু হু করে, এখন তাঁরা ১৪৭টা দেশে টিকা পাঠান, ব্যবসার সিংহভাগই দাঁড়িয়ে আছে রফতানির ওপরে। ভারতেও ব্যবসা বাড়ছে, গত ১০ বছরে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রযুক্তির ওপর। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে নতুন নতুন প্রযুক্তি আনা হচ্ছে।

এ বছর তাঁরা বার করেছেন রোটাভাইরাস টিকা, যা ফ্রিজে রাখার দরকার নেই, ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা যাবে।

পড়াশোনার থেকে আদার বেশি গুরুত্ব দেন অভিজ্ঞতায়। তিনি নিজে আইভি লিগ স্কুলে পড়াশোনা করেননি, তাঁর কাছে হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট আর পুনের হাদাসপার গ্র্যাজুয়েটের তফাত নেই। অভিজ্ঞতা, এক্সপোজার, ভুল করা আর ঠিক করা কাজ শিখিয়েছে তাঁকে।

আদার তাঁর পিতার একমাত্র সন্তান। এ বিষয়ে সাইরাস বলেছেন, আমার তো একটাই ছেলে। অনিচ্ছার সঙ্গে সে দুই ছেলের জন্ম দিয়েছে, তার স্ত্রীর তো একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। আমাদের পরিবার খুব ছোট। তাই সম্পত্তি কাকে দেব, তা নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই, আদারের বরং ভবিষ্যতে দুই ছেলের মধ্যে সম্পত্তি ভাগে সমস্যা হতে পারে।

পুনাওয়ালাদের একটা বড় শখ নামীদামী শিল্পীদের ছবি সংগ্রহ। আদার পুনাওয়ালা বলেছেন, সম্ভবত তাঁদের কাছে ভারতের সেরা ইউরোপীয় সংগ্রহ আছে। ৭০-৭০ মিলিয়ন ডলারের ছবি কিনেছেন তাঁরা। এটা প্যাশনও বটে, বিনিয়োগও বটে। ক্রিস্টিস আর সদবিস নিলাম ঘর থেকে তাঁরা ছবি কেনেন, ব্যক্তিগতভাবে নয়। ছবি কেনার অন্যতম শর্ত হল, তা শিল্পীর সেরা সময়ের ছবি হতে হবে, তাতে তাঁর স্বাক্ষর থাকতে হবে।  মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর স্বাক্ষর সহ ১৯৩১-এ আঁকা একটি পেনসিল পোর্ট্রেট সাইরাস কিনেছেন ৩২,৫০০ পাউন্ড খরচ করে।

পুনেতে ঘোড়ার ফার্মও আছে পুনাওয়ালাদের। আদারের ঠাকুর্দা সলি এ পুনাওয়ালা প্রতিষ্ঠা করেন পুনাওয়ালা স্টাড ফার্মস। ঘোড়া রফতানি করেন তাঁরা, ব্রিড করেন চ্যাম্পিয়ন রেস হর্স। সপ্তাহের শেষে ছুটি কাটাতে তাঁরা আসেন ফার্মে। তবে ছুটি কাটাতে তাঁদের পছন্দের ঠিকানা সুইস আল্পস আর ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা। ইয়ট ভাড়া করে সমুদ্রে পাড়ি দেন তাঁরা, বন্ধুদেরও ডাকেন। আর পছন্দ সেইলিং আর স্কিইং। আদারের গাড়ির সংগ্রহ দুর্দান্ত। ৩০-এর বেশি গাড়ি আছে তাঁর। কিন্তু সে সব বিশেষ ব্যবহার করেন না, সেডানই তাঁর পছন্দ, বিশেষ করে রোলস রয়েস আর বেন্টলি। আর কাজের জন্য এস ক্লাস মার্সিডিস।

২০১১-য় সিরাম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে আদারের প্রয়াত মায়ের নামে ভিলু পুনাওয়ালা ফাউন্ডেশন। এই সংস্থা বিভিন্ন গ্রামে ৬টি স্কুল, ১টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে, পুনেয় চালায় ক্লিন সিটি ইনিশিয়েটিভ। বেলজিয়াম ও হল্যান্ড থেকে ১৫০-১৭০টি ট্রাক ও অন্যান্য মেশিন এনেছে তারা, সেগুলি এই কাজে ব্যবহার করে। এবার তারা ঘরে ঘরে স্বচ্ছ পানীয় জল পৌঁছে দিতে চায়।